নাগরিক সেবার নতুন দিগন্ত ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার

0

মোস্তফা রুহুল কুদ্দুস ॥ তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার নাগরিক সেবার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। অজপাড়াগাঁয় অশিক্ষিত অনভিজ্ঞ মানুষ এখন সহজে এই কেন্দ্র থেকে সেবা পাচ্ছেন। এর ফলে যেমন অতিরিক্ত অর্থ ও সময় ব্যয়ের বিড়ম্বনা কমেছে, তেমনি অফিস আদালত ঘিরে গড়ে ওঠা দালাল-প্রতারক চক্রের বিচরণ ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে এসেছে। নাগরিক জীবনে এই সুবিধা এনে দিয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে নাগরিক সেবা সহজিকরণ ও গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারই অংশ হিসেবে ২০১০ সালে ইউনিয়ন পর্যায়ে গড়ে তোলা হয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার-ইউডিসি। স্থানীয় সরকার বিভাগের তত্ত্বাবধানে স্ব-স্ব ইউনিয়ন পরিষদ এটা পরিচালনা করে। নাগরিক সেবা সুনিশ্চিত করতে কেন্দ্রে একজন পুরুষ ও একজন নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন।
যশোরে এই কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) শাম্মী ইসলাম জানান, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে প্রায় দুই শ প্রকার সেবা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সেবা হচ্ছে জমির পর্চা তোলা, নামজারি আবেদন, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, পাসপোর্ট/ভিসার আবেদন, ব্যাংকিং সুবিধা, বিধবা, বয়স্ক, প্রতিনিধি ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতা উত্তোলনে সহায়তা, জন্ম-মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশ কায়েম সার্টিফিকেট, কৃষি বিষয়ক পরামর্শ প্রভৃতি। ডিজিটাল সেন্টার চালুর আগে প্রয়োজনীয় কাজে গ্রাম-গঞ্জের মানুষকে ছুটতে হতো জেলা সদরে। আবেদন করতে হতো রেকর্ড রুমে। গ্রামের সহজ-সরল, অশিক্ষিত অনভিজ্ঞ মানুষ দূরের পথ মাড়িয়ে শহরে আসতে পারলেও অফিসিয়াল প্রক্রিয়া বুঝতো না। এই সুযোগে অফিস কেন্দ্রিক দালাল-প্রতারক চক্র গড়ে ওঠে। তারা অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কাজ করে দিতো। সময়ও লাগতো বেশি। একেকটি কাজের জন্যে সেবা প্রত্যাশীকে বার বার জেলা সদরে আসতে হতো। তাতে বাড়তি সময় ও অর্থ ব্যয় হতো। এখন আর কিছুই লাগে না। অধিকাংশ সেবা বাড়ি বসে দ্রুত পাওয়া যায়। একটি পর্চা তুলতে ১০০ টাকা ও নামজারি আবেদন করতে লাগে ২০০ টাকা। অন্যান্য ফি আরও কম। সেবা প্রত্যাশীকে শুধুমাত্র আবেদনের জন্যে ডিজিটাল সেন্টারে যেতে হয় সেজন্যে কোনো টাকা খরচ হয় না। সেখানে পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে যাতায়াত করা যায়। এতে সময় ব্যয় হয় সর্বসার্কুল্যে ঘন্টাখানেক। এরপর কাক্সিক্ষত কাজ সম্পন্ন হলে বা কোন পর্যায়ে আছে তা কেন্দ্র থেকে মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়। যশোর সদরের আরবপুর ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা আরিফুজ্জামান জানান, আবেদনের সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে সেবা প্রত্যাশী তার কাজের ফলাফল বাড়ি বসে জানতে পারেন। যশোর জেলা কেশবপুর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার একটি গ্রাম ভেরচি। সেখান থেকে জেলা সদরের দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। যাতায়াত ব্যবস্থাও ভালো না। এ গ্রামের বাসিন্দা মোসলেম উদ্দিনের জমিজমা সংক্রান্ত মামলা চলছে। তিনি জানান, মামলার জন্যে জমির পর্চা তুলতে তাকে কয়েকবার রেকর্ড রুমে যেতে হয়। দালাল ছাড়া সেখানে সেবা মিলতো না। সব মিলিয়ে তার সময় ও অর্থ ব্যয় হতো কয়েকগুণ বেশি। মোসলেম উদ্দিন এখন পায়ে হেঁটে ডিজিটাল সেন্টারে যান। বাড়ি বসেই তার সব প্রয়োজন মিটে যায়। মনিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়নের প্রতিবন্ধী ভাতা ভোগকারী পঙ্গু আবু বকর সিদ্দিক জানান, আগে ভাতা তুলতে উপজেলা সদরে যেতে হতো। এখন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যে কার্ড করে দেওয়া হয়েছে, তা দেখিয়ে বড়ির পাশে অবস্থিত ব্যাংকের এজেন্ট শাখা থেকে তোলা যায়। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়া অনেক নারী-পুরুষ তাদের বয়স্ক ও বিধবা ভাতা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পেয়ে যান। ২০২০ সালে যশোর সদর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে প্রায় ১৭ হাজার দলিল সম্পাদন হয়েছে। নামজারি/নামপত্তন সম্পন্ন হয়েছে সমপরিমাণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় আরএস, সিএস, এসএ পর্চা, আইডি কার্ড ও ছবি। আরও সাতটি রেজিস্ট্রি অফিস রয়েছে যশোরে। সেখানেও প্রচুর জমি রেজিস্ট্রি ও নামপত্তন হয়। সকলকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সিংহভাগই সরবরাহ করেছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবাদে সেবা গ্রহণকারীরা অতি সহজে ও স্বল্প সময়ে কাক্সিক্ষত সুবিধা পেতে সক্ষম হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ যশোরের উপ-পরিচালক হুসাইন শওকত বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ডিজিটাল বাংলাদেশ। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার তারই ফসল। এর সব সেবা এখনো চালু হয়নি। মানুষের অতি প্রয়োজনীয় সেবা ডিজিটাল সেন্টারে পাওয়া যাচ্ছে। আগামীতে কোনো কাজে মানুষকে বাইরে যাওয়া লাগবে না।