যশোরে ‘কাগুজে’ লকডাউন

0

তহীদ মনি ॥ আগামী ১৬ মে পর্যন্ত যে লকডাউনের ঘোষণা রয়েছে, যশোরে অনন্ত তা কাগুঁজে লকডাউনে পরিণত হয়েছে। বাজার, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফুটপথ চলাচলের রাস্তা কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব। এপ্রিল থেকে দফায় দফায় লকডাউনের সময় বাড়ালেও ঘোষণার ভেতর নানা ফাঁক থাকায় কোথাও কার্যকর হয়নি লকডাউন। শেষ পর্যায়ের লকডাউন ভাঙার প্রবণতা যেমন সাধারণ মানুষের তেমনি ব্যবসায়ীদের। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই লকডাউন ও মানুষের সচেতনতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। পুরো শহরটা যেনো পরিণত হয়েছে। মানুষের সমুদ্রে। চলছে স্বাভাবিক ঈদ বাজার। এপ্রিলে ১ম দফা লকডাউনে যে ১৮ দফা বিধিনিষেধ ছিল ধীরে ধীরে তা শিথিল হয়। চলছে শেষ দফার লকডাউন, পরিবহন বাস চলাচল বাদে আর সবকিছু চলছে স্বাভাবিক। তাই সব চিত্রই পাল্টে গেছে। যশোর শহরের সকল রাস্তা মানুষের ভিড়ে ঠাসা। একইভাবে পথচলা দায় বিভিন্ন ছোট বড় গাড়ির ভিড়ে। আর শহরের কেন্দ্রস্থলের অলিগলি জুড়ে ভাসমান দোকান, ফুটপথে দোকান। বড় বাজারের সর্বত্রও বেচাকেনা, ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে কোথাও মহামারীর শংকা নেই। এসব এলাকার যেকোনো জায়গায় তাকালে মনে হয় মানুষের মেলা বসেছে। কোথাও করোনার কারণে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের বিন্দুমাত্র প্রভাব চোখে পড়ে না বলে জানিয়েছেন একাধিক সচেতন মানুষ। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও কার্যত তারা মোটরসাইকেল থামানো ছাড়া আর কোন কাজ করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। পথচারীদের দাবি, করোনায় লকডাউন মানানোর জন্যে পুলিশ শহরের বিভিন্ন মোড়ে ছিল। এখন পুলিশের চোখের সামনে যাত্রীবাহী ছোট ছোট গাড়ি চলছে, জেলখানার মোড় থেকে কাঠেরপুল হয়ে বড় বাজার, অথবা সেখান থেকে দড়াটানা, দড়াটানা থেকে থানা মোড় হয়ে চারখাম্বা কোথাও লকডাউন কার্যকরের উদ্যোগ নেই। শহরের নিয়মিত যাতায়াতকারী কয়েকজন বললেন, পুলিশের সামনে মুজিব সড়কে ভাসমান দোকানোর যে ভিড়, লকডাউন অকার্যকর প্রমাণ করার জন্যে সেটাই যথেষ্ঠ। আর বকুলতলা বা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল পর্যন্ত এবং দড়াটানা ব্রিজ সবখানেই জনসমুদ্র, পুলিশ নিস্ক্রীয়। সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের মেয়াদ ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ সময় দোকানপাট, শপিংমলসহ অনেক অফিস খোলা রয়েছে। খোলা রয়েছে ব্যাংক। কাঁচা বাজার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান বা মার্কেট তো সবসময়ই চালু। ওষুধ, খাবারের দোকান সবই চালু। আর যে কেউ জেলার যে কোনো প্রাপ্ত থেকে শহরের যে কোনো প্রকার কেনাকাটা বা অন্যান্য প্রয়োজনে সহজেই প্রবেশ করতে পারছেন। ট্রাকে সড়ক মহাসড়কে মালামাল পরিবহন করা যাচ্ছে। ইজিবাইক, নসিমন, করিমন, ভ্যান, রিকশা, দূর-দূরান্তে চলাচল করা যাচ্ছে। মণিহার, পুরাতন বাস টার্মিনাল থেকে সিএনজিতে চড়ে খুলনা পর্যন্ত যাতায়াত করা যাচ্ছে। চাঁচড়া থেকে বেনাপোল, খাজুরা স্ট্যান্ড এলাকা থেকে মাগুরা এবং পালবাড়ি থেকে খুব সহজে ঝিনাইদহের বারবাজারে যাওয়া যাচ্ছে। যাত্রীদের মতে, ভাড়া বেশি গুণতে হচ্ছে, সময় একটু বেশি যাচ্ছে। তাছাড়া লকডাউনের কারণে কোন কিছু থেমে নেই। বেশ কয়েকজন ক্রেতা জানালেন, তরমুজ, আনারস, আঙ্গুর বা এ জাতীয় ফলের দোকানে গেলে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বিক্রেতারা জানান, লকডাউনের কারণে ভাড়া বেশি দিতে হয়। ক্রেতাদের অভিযোগ, এই লকডাউনের মানে কী ? বড় বাজারে ঈদের কেনাকাটা করতে আসা কয়েকজন ক্রেতা জানালেন, ভেবেছিলাম লকডাউনে শহর ফাঁকা থাকবে, সহজে কেনাকাটা করে ফেরা যাবে কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাজারে পা ফেলার জায়গা নেই। শহরতলীর জামিলা খাতুন জানান, খুব প্রয়োজন কিছু ওষুধ ও কাপড় কিনতে শহরে এসে ভিড় দেখে হতবাক তিনি। তার মতে, টেলিভিশনে প্রতিদিন লকডাউনের কথা বলে কিন্তু এটা কেমন লকডাউন! কয়েকজন চাকরিজীবী জানান, নিয়মিত অফিস করতে হচ্ছে। বেশি ভাড়া দিয়ে গাদাগাদি বসে সিএনজি-ইজিবাইকে চড়তে হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি শারীরিক দূরত্ব কোথাও নেই। শহরের আব্দুল মান্নান বলেন, দড়াটানায় দাঁড়িয়ে থাকেন, ভিড় আপনাকে ঠেলে ঠেলে এদিকে থানার মোড় অথবা ওদিকে প্রেসক্লাবের মোড় পর্যন্ত নিয়ে যাবে। আপনাকে আর হাঁটতে হবে না। গৃহবধূ আলেয়া জানান, লকডাউনে শুনে প্রথমে বাজারে আসিনি কিন্তু সবাই বলছে জামাকাপড় জুতা সবই কেনা যাচ্ছে তাই ছেলেমেয়েদের জন্যে কিনতে এসে ভিড় আর ধাক্কাধাক্কিতে হাঁটতে পারছি না। এ জাতীয় কথা প্রায় সবারই। শাহআলম নামে একজন কলেজ শিক্ষক বললেন লকডাউন! ওটা খাতা কলমে, সংবাদপত্রে টেলিভিশনে আর সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের কথায়। তিনি বললেন, প্রতিদিন যশোরের খবরের কাগজগুলোতে লিখছেই কোথাও লকডাউন মানা হচ্ছে না। যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন-অর-রশিদ ফুলু জানান, সব কিছু খোলা রেখে শুধু বাস বন্ধ রেখে কীভাবে লকডাউন চলছে আমরা বুঝতে পারছি না। লকডাউন সত্ত্বেও বাজারের উপচেপড়া ভিড় নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা আছে কিনা এমন প্রশ্নে পৌর মেয়র হায়দার গনি খান পলাশ বলেন, বাজারে ভিড় কমানোর জন্যে পুলিশ বা প্রশাসন যদি উদ্যোগ নেয় তাহলে বিভিন্ন টিমে তিনি কাউন্সিলরদেরকে যুক্ত করবেন সহায়তা করার জন্যে। যশোরের জেলা প্রশাসক করোনা প্রতিরোধ কমিটির প্রধান মো. তমিজুল ইসলাম খান, এ প্রসঙ্গে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, জনগণ সচেতন না হলে, জনপ্রতিনিধিরা সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে এগিয়ে না এলে ব্যবসায়ীরা তাদের ভূমিকা যথাযথভাবে না পালন করলে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া সম্ভব না। তিনি জানান, শুরু থেকেই যশোরের জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন সরকারি-নির্দেশ প্রতিপালনের জন্যে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্যে নানামুখি ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন তাদের জনবল অন্যান্য কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারত থেকে আসা দু’হাজার জনের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতে কাজ করছে। তারা রাতদিন পরিশ্রম করেও জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সেক্টরের নেতাকর্মী আছেন তারা সহযোগিতা করলে লকডাউন যথাযথভাবে পালন হতো। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সাড়া মিলছে না।