এবারেও বোরো সংগ্রহের সফলতা নিয়ে সংশয়

0

সুন্দর সাহা॥ বাজার দামের সাথে সরকারের সংগ্রহ মূল্যের অসঙ্গতির কারণে গত বোরো ও আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হয়। বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল আমদানিও করা যায়নি, তাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে সরকারি খাদ্যশস্যের মজুত। এই পরিস্থিতিতে ধান ও চালের দাম বাড়িয়ে শুরু হয়েছে খাদ্য অধিদফতরের বোরো সংগ্রহ অভিযান। তবে করোনা মহামারি, লকডাউন, বাজারে ধান-চালের অস্বাভাবিক দামসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বোরো ধান ও চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন মিলার ব্যবসায়ীসহ খাদ্য বিভাাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান ও চাল সংগ্রহের মাধ্যমে আপদকালীন খাদ্যশস্যের মজুত গড়ে তোলে। একইসঙ্গে বাজারে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করা হয়, যেন দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে। বোরো দেশের সবচেয়ে বড় ফসল। কৃষক, ব্যবসায়ী, মিল মালিকসহ সাধারণ মানুষ তাকিয়ে থাকে বোরো ধানের উৎপাদনের দিকে। একইভাবে বোরো মৌসুম থেকেই সরকার সবচেয়ে বেশি ধান-চাল সংগ্রহ করে।
খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে মোট ১৮ লাখ টন ধান ও চাল ক্রয় করা হবে। এর মধ্যে মিলারদের কাছ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৯ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনা হবে। অন্যদিকে কৃষকদের কাছ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে সাড়ে ছয় লাখ টন ধান কেনা হবে। গত ২৮ এপ্রিল থেকে ধান কেনা শুরু হয়েছে। আর ৭ মে থেকে শুরু হবে চাল সংগ্রহ। বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। গত বছর বোরোতে এবং এবার আমনে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচি ব্যর্থ হয়। খুলনার আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান খান জানিয়েছেন, “এবারের কমিটি খুবই শক্তিশালী। আগের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতার আলোকে এবার বোরো সংগ্রহ কর্মসূচি সফল করতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এবার বোরো ধানের বাম্ফার ফলন হয়েছে। বোরো ধান কাটা অনেকটা এগিয়েও গেছে।” কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী আর মিলাররা। তারা বলছেন, বাজার দরের সাথে সরকারের সংগ্রহ মূল্য সামঞ্জস্য নয়। তাই চাল ক্রয় আংশিক সফল হলেও ধান ক্রয় সফল কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। খাদ্য অধিদফতর সূত্র আরও জানায়, গত আমন মৌসুমে দুই লাখ টন ধান, ছয় লাখ টন সিদ্ধ চাল ও ৫০ হাজার টন আতপ চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতিকেজি আমন ধান ২৬ টাকা, চাল ৩৭ টাকা ও আতপ চাল ৩৬ টাকা। গত বছরের ৭ নভেম্বর থেকে সংগ্রহ শুরু হয়। ধান-চাল কেনার তারিখ নির্ধারিত ছিল চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। পরে তা বাড়িয়ে ১৫ মার্চ পর্যন্ত করা হয়। আমনে দুই লাখ টন ধানের বিপরীতে মাত্রা ১২ হাজার ৩৪২ টন সংগ্রহ হয়। ছয় লাখ টন সিদ্ধ চালের বিপরীতে ৭০ হাজার ১৩৬ টন এবং ৫০ হাজার টন আতপ চালের বিপরীতে চার হাজার ৮৬৩ টন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। গত বোরোতে ১০ লাখ টন ধান, ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল ও দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ২৬ টাকা কেজি দওে ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চাল এবং ৩৫ টাকা কেজি দরে আতপ চাল কেনার সিদ্ধান্ত হয়। গত বছরের ২৬ এপ্রিল থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বোরো সংগ্রহ কার্যক্রম চলে। ওই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে দুই লাখ ১৯ হাজার টন ধান, ছয় লাখ ৬৭ হাজার ৮৯০ টন সিদ্ধ চাল এবং ৯৯ হাজার ১২৩ টন আতপ চাল কিনতে সক্ষম হয় খাদ্য অধিদফতর। গত বোরো ও আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহে এ ব্যর্থতার কারণে সরকারি খাদ্য শস্যের মজুত আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। সর্বশেষ গত এপ্রিলে খাদ্যশস্যের মোট মজুতের পরিমাণ নামে পাঁচ লাখ টনেরও নিচে। এর মধ্যে চাল প্রায় তিন লাখ টন এবং গম প্রায় দুই লাখ টন।
যশোর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লোকসমাজকে বলেন, “ধান চাল সংগ্রহের মূল্য বৃদ্ধি করার কারণে এবার সংগ্রহ অভিযান সফল হবে বলে আমরা আশাবাদী। তবে সবকিছু নির্ভর করছে বাজার পরিস্থিতির উপর।” খুলনা বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহাবুবুর রহমান খান লোকসমাজকে বলেন, “এবার বোরো ধানের ভাল উৎপাদন হয়েছে। কয়েকটি মন্ত্রণালয় নিয়ে গঠিত হয়েছে শক্তিশালী কমিটি। আবার কৃষক ও মিলারের স্বার্থের কথা বিরেচনা করে সরকার ধান ও চালের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি। মন্ত্রী ও সচিবসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সে কারনে আমরা এবার সংগ্রহ অভিযান সফলের আশা করছি। তবে, করোনা এবং লকডাউনের কারণে বাজার পরিস্থিতি ভিন্নদিকে মোড় না নিলে এবার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করছি।” এ বিষয়ে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী লোকসমাজকে বলেন, ‘পরিস্থিতি এখনো বোঝা যাচ্ছে না। এখন বাজারের যা অবস্থা; প্রতি কেজি ধানের দাম ২৭ টাকা হলে সরকারের হিসাবেই তো এক কেজি চালের দাম ৪২ টাকার বেশি হয়। বাজার যদি ফেবার করে তবে আমরা সরকারকে চাল দিতে পারব। বাজার ফেবার না করলে সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘এখনই কাঁচা ধানের মণ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে সোয়া ৯০০ টাকা। এক মণ ধান শুকালে ওজন কমে হবে ৩০ কেজি। তাহলে শুকনো এক কেজি ধানের দাম এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা হচ্ছে। পরিস্থিতি এই হলে আমরা কীভাবে চাল দেব?’ ‘আমাদের কথা লস দিয়ে আমরা চাল দিতে পারব না। তবে লাভ না হলেও আমরা সরকারকে চাল দেব। এদিকে মাঠ পর্যায়ের মিলার, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট কর্তারা বলছেন, বাজার দর অপরিবর্তিত থাকলে অটো রাইস মিল মালিকরা চাল দিতে পারলেও হাসকিং মিল মালিকরা চাল দিতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) সাথে লোকসমাজের পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, “বিগত দু-মৌসুমের অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি। বাজারমূল্যটা বেশি ছিল, আমরা কম দাম ঘোষণা দিয়ে ধান চাল কিনতে পারিনি। আমরা আশা করি, এবার ভালো দাম দিতে পারছি, ইনশাআল্লাাহ আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করব।” ড. নাজমানারা খানুম বলেন, “মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সবারই আমরা সহযোগিতা চাইছি, আমরা মিটিং করে যাচ্ছি। আশা করি, আমরা লক্ষ্য অর্জন করতে পারব।” চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের কোথাও একটা অসামঞ্জস্য আছে জানিয়ে খাদ্য সচিব বলেন, “আমরা ভালো উৎপাদন করছি, আমদানি করছি, এরপরও কিন্তু দাম কমছে না। আমাদের উৎপাদন ও যোগানের সঠিক তথ্যটি দরকার।”