মোদিকে হটানোর লড়াইয়ে মমতাই এখন বিরোধীদের প্রেরণা!

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সব জল্পনা উড়িয়ে আবারো পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করেছেন মমতা ব্যানার্জি। অসম এই লড়াইয়ে তিনি শুধু বিজেপি’কেই হারাননি, হারিয়েছেন ভারতের পরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও। গত রোববার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা হতেই গোটা ভারতে মোদি-বিরোধী শিবিরে নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। কিন্তু এরপর? টানা তৃতীয়বারের মতো বঙ্গজয়ী মমতার এবারের লক্ষ্য কি তবে দিল্লি? এ নিয়ে লিখেছেন ভারতীয় সাংবাদিক ব্রজেশ কুমার সিং।
তার ভাষায়, পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ফলাফল তখন স্পষ্ট। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের প্রবল চেষ্টা উড়িয়ে বাংলার মসনদে তৃতীয়বারের মতো মমতা ব্যানার্জির বসা নিশ্চিত। এমন মুহূর্তে তার কাছে একটি টিভি চ্যানেলের প্রশ্ন ছিল, ‘এবারের নির্বাচন কি বেশি চ্যালেঞ্জের ছিল?’ তখন মাত্রই নন্দীগ্রামে মমতার পরাজয়ের খবর সামনে এসেছে। তা সত্ত্বেও গোটা দলকে কাঁধে বয়ে জিতিয়ে আনা মমতা উত্তর দেন, ‘গোটা দেশের জন্য এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মানুষের আশীর্বাদে সেই নির্বাচনে জিতেছি। দেশবাসীর কথা বিবেচনায় এই নির্বাচন আমার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।’ তাহলে কি এবারের লক্ষ্য দিল্লি?’ মমতার জবাব, ‘এখন প্রথম লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে করোনা থেকে বাঁচানো। সেটি আগে মিটিয়ে তারপর বাকি সব।’ অর্থাৎ বার্তা স্পষ্ট, দিল্লিতে ঠিকই নজর রেখেছেন তৃণমূল নেতা।
বস্তুত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফল স্পষ্ট হতেই সমাজবাদী পার্টি থেকে শিবসেনা, এএপি (আমআদমি পার্টি) থেকে ন্যাশনাল কনফারেন্স- সব বিরোধী দলের নেতারাই মমতার লড়াকু, একরোখা ভূমিকার অকুণ্ঠ প্রশংসা করছেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে একের পর এক টুইট ও বিবৃতি। তারাও যেন ধরে নিয়েছেন, মোদিকে হারাতে মমতাই হতে পারেন একমাত্র মুখ! পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আসাম, তামিলনাড়ু, কেরালা ও পুদুচেরিতে ‘প্রত্যাশিত’ ফলাফলই করেছে পদ্ম শিবির। আসামে ক্ষমতা ধরে রাখা, তামিলনাড়ু-কেরালায় পরাজয়, কেন্দ্রশাসিত পুদুচেরিতে জয়- বিজেপির এসব পরিকল্পনা ‘ফেল’ করেনি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে গেরুয়া শিবিরের যে বিশাল পরিকল্পনা ছিল, তা মাঠে মারা পড়েছে এক মমতা-ঝড়ে। ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে বিজেপির ‘এইবার, দুশো পার’ দাবি। তাই নন্দীগ্রামে নিজে হারলেও মমতা আসলে গোটা বিজেপিকেই হারিয়ে দিয়েছেন। আর তার এই ‘ফর্মুলা’ই এখন গোটা ভারতে ব্যবহার করতে চাইছেন বিরোধীরা।
রাজনৈতিক মহলের মতে, জয় অনেকটা আফিমের নেশার মতো, যা কিছু মানুষকে মারাত্মক শক্তি দিয়ে থাকে। মমতা ব্যানার্জির কাছে নির্বাচনে জয়ও অনেকটা তেমনই। নন্দীগ্রামের বিরুলিয়া বাজারে ভোটের কত আগে পায়ে চোট পান তিনি। চিকিৎসকরা তাকে একমাস বিশ্রামে থাকতে বললেও তা মানেননি তৃণমূল সুপ্রিমো। দু’দিন পর থেকেই পায়ে প্লাস্টার আর হুইল চেয়ারকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়েন ভোটের প্রচারে। সেই অবস্থায় শেষ করেন আট দফার নির্বাচন। অবশেষে রোববার ‘নিজের’ পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন মমতা, অবশ্য বঙ্গজয় নিশ্চিত করে তারপর। এবারের নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের হলেও তা আদতে হয়ে উঠেছিল মোদি বনাম মমতার লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে জয় ছিনিয়ে আনতেই মমতাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বিরোধী শিবির। যদিও বিজেপির কাছে আপাতত নন্দীগ্রামে মমতার পরাজয়টাই যা একটু ‘স্বস্তির’ জায়গা। আর আসামে ক্ষমতা ধরে রাখায় তাদের মুখরক্ষা। রাজনৈতিক মহলের একাংশের ধারণা ছিল, আসামে সর্বানন্দ সোনওয়াল ও হিমন্ত বিশ্বশর্মার অন্তর্দ্বন্দ্ব কংগ্রেসকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে। যদিও বাস্তবে কংগ্রেস ও বরউদ্দিন আজমলকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছে বিজেপি। অপরদিকে, পুদুচেরিতেও প্রথম খাতা খোলা ‘দুঃসময়ে’ গেরুয়া শিবিরকে আরেকটু শান্তি দিতে পারে। কেরালায় এতদিনের ঐতিহ্য ছিল, একবার বাম এবং একবার কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসা। এবার প্রায় চার দশকের সেই রীতি বদলে ক্ষমতা ধরে রেখেছে বামজোট। কংগ্রেসের জোট সেখানে দ্বিতীয় আর তৃতীয় বিজেপি। গেরুয়া শিবিরের কাছে এই ফল অপ্রত্যাশিত নয় একেবারেই। যেমন অপ্রত্যাশিত নয় তামিলনাড়ুর ফলাফলও। দক্ষিণের রাজ্যটিতে ১০ বছর পর ডিএমকে ক্ষমতায় আসছে, বিজেপি-র জোটসঙ্গী এআইএডিএমকে নয়, তা ভোটের আগেই কার্যত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ভোটের ফলাফলেও তাই প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু আসল লড়াই ছিল পশ্চিমবঙ্গে। রাজ্যটি নিয়ে বিজেপির স্বপ্ন ছিল বিরাট। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ান মমতা। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘খেলা হবে’। মোদি-শাহরা যতই ২০০ আসন জেতার দাবি করুন না কেন, তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন বিজেপি নেতারাই। তবে ক্ষমতায় আসার বিষয়ে অন্তত কোনো সন্দহ ছিল না তাদের কারো মনে। বঙ্গের মুসলিম ভোট তৃণমূলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদের রাজনীতি আমদানি করে বিজেপি। দূর্গাপূজা, সরস্বতী পূজায় মমতা সরকারের বিরুদ্ধে বাধা দেয়ার অভিযোগ তোলে তারা। ছিল মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিপুল প্রচারও। কিন্তু শেষপর্যন্ত লাভের খাতায় যোগ হলো শূন্য। এক মমতার কাছে ধরাশায়ী হলেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের মতো বাঘা বাঘা নেতা। মমতা অবশ্য পাল্টা হাজির হয়েছিলেন বহিরাগত তত্ত্ব নিয়ে। তিনি নির্বাচনী সভাগুলোতে বারবার বলেছেন, ‘বাংলাকে গুজরাট হতে দেব না। বহিরাগতদের বাংলা লুট করতে দেব না।’ এর সঙ্গে প্রশান্ত কিশোর মস্তিষ্কপ্রসূত ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ স্লোগান তুলে বাঙালি চেতনাও জাগিয়ে তুলেছিল তৃণমূল। লোকসভা নির্বাচনের পর মমতার নির্বাচনী কৌশলী হয়ে এসে দলের তৃণমূল পর্যায়ে সমীক্ষা, স্থানীয় ইস্যু নিয়ে কাজ এবং সেইমতো রণকৌশল তৈরি করে তৃণমূল কংগ্রেসকে ছকে বসিয়ে দিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর তথা পিকে। তার বুদ্ধিতে ‘দিদিকে বলো’, ‘দুয়ারে সরকার’, ‘পাড়ায় সমাধানে’র মতো কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের কাছে ফের গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পায় তৃণমূল। সেই সুর এখন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতে। রোববার ভোটে জয়ের পরপরই দেশবাসীকে বিনামূল্যে করোনা টিকা দেয়ার দাবি জানিয়ে মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা দেন, ‘বিনামূল্য টিকা না দিলে অহিংস আন্দোলন করব।’ একই ইস্যুতে শারদ পওয়ার, সীতারাম ইয়েচুরি, উদ্ধব ঠাকরে, সোনিয়া গান্ধীসহ মোট ১৩ জন বিরোধী নেতার সঙ্গে মমতার একটি যৌথ বিবৃতিও প্রকাশ হয়। ভারতীয় গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, করোনা মহামারি নিয়ে মোদি সরকারকে চেপে ধরতে সোনিয়া গান্ধী নন, বরং মমতাকেই সামনে রাখতে চান বিরোধীরা। বাস্তবে মমতার মোদি-বিরোধিতার শুরু সেই ২০১৪ সাল থেকেই। লোকসভা নির্বাচনে জিতে নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে তার বিরোধিতা করেছেন মমতা ব্যানার্জি। বিজেপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ধর্মীয় মেরুকরণ, সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে বারবার সরব হয়েছেন তিনি। নোটবাতিল থেকে জিএসটি নীতি, সিএএ, এনআরসি’র মতো নানা ইস্যুতে সবচেয়ে জোরালো বিরোধীস্বরও ছিলেন মমতা। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি-বিরোধী দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করেছিলেন মমতা। দাবি করেছিলেন, ভোটে জিতে মোদি-বিরোধীরাই সরকার গড়বে। শেষপর্যন্ত তা হয়নি। ফের ক্ষমতায় আসেন নরেন্দ্র মোদি। তবে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন অনেক সমীকরণ বদলে দিয়েছে। মমতা দেখিয়ে দিয়েছেন, ‘শক্তিমান’ মোদিকে তিনি হারাতে পারেন। এখন মমতার সেই সাফল্যকেই ২০২৪ পর্যন্ত এগিয়ে নিতে চান বিরোধীরা। বলা হচ্ছে, দেশটিতে যা পরিস্থিতি তাতে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন হতে চলেছে মোদি বনাম মমতার লড়াই।
সূত্র: নিউজ১৮