খুলনা বিভাগজুড়েই পানির জন্য হাহাকার

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু সেই পানির জন্য খুলনা বিভাগজুড়ে চলছে হাহাকার। খুলনা বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় পানির পাত্র নিয়ে চলছে মানববন্ধন, প্রতিবাদ বিক্ষোভ। দীর্ঘ ৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি না হওয়ায় এই অঞ্চলের পানির স্তর এলাকাভেদে ২ থেকে ৪শ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে। খাবার পানির জলশয়গুলো শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে আরও আগেই, নলকূপগুলোও অকেজো হয়ে গেছে। প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে শুধু একটু পানীয় পানির জন্য দৌড়াতে হচ্ছে কয়েক কিলোমিটার। তাতেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত পানি। এমন পরিস্থিতিতে আরও বেশি জলাধার নির্মাণের তাগাদা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। পানির চাহিদা পূরণ করতে অনেক মানুষ নিজের উদ্যোগে খাবার পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেসব স্থানে পানির জন্য সবসময় দীর্ঘ লাইন পড়ে থাকছে। বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনডিপির এক যৌথ জরিপ অনুযায়ী, দেশের উপকূলীয় এলাকার অধিবাসীদের পারিবারিক আয়ের ২০-২৫ শতাংশ ব্যয় হয় শুধু খাওয়ার পানির জন্য। জাতিসংঘের পানি বিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, একজন মানুষের আয়ের ৩ শতাংশ অর্থ খরচের মাধ্যমে তার জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে।
নগরীর টুটপাড়া ঘোষের ভিটা এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রশিদ, বেলাল হোসেন বাবু, হাজেরা খাতুন, আনোয়ারা বেগমরা বলেন, টিউবওয়েলের পানি আমাদের একমাত্র খাবার পানির উৎস। এখন থেকে শুরু করে বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত কল থেকে মোটেও পানি ওঠে না। যার কারণে আমাদের মতো যারা অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকে তাদের জন্য খাবার পানির সমস্যাটা প্রকট। সাত রাস্তা মোড়ের ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলাম বলেন, বাড়ি করার সময় এই এলাকায় অনেকেই টিউবওয়েল স্থাপন করেছেন। কিন্তু এখন তারাও পানি পাচ্ছেন না। ওয়াসার পানির ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু সেই পানিও এই সময় ঠিকমতো মিলছে না। পানির সংকট শুধু খুলনা মহানগরীতেই নয়, মহানগরীর চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা উপজেলার গ্রামগুলোতে। একই অবস্থা খুলনা বিভাগের উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গাসহ উপজেলাগুলোতে। খুলনা শহরে ওয়াসা ও সাব মার্সেবল থেকে পানি পানের সুযোগ থাকলেও গ্রামে সেই অবস্থাও নেই। গ্রামের অনেককেই পানযোগ্য এক কলস পানির জন্য কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। আর যারা দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দিতে পারছেন না তাদের নগদ টাকার বিনিময়ে কিনতে হচ্ছে খাবার পানি। খুলনা ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, নগরে নিত্যকাজের জন্য পানির চাহিদা অনেকাংশে খুলনা ওয়াসা পূরণ করতে পারছে। কিন্তু পানীয় পানির চাহিদা মেটাতে পারছে না। টিউবওয়েলের পানিই নগরবাসীর একমাত্র ভরসা।
খুলনা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, খুলনায় গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হতে না হতেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির স্তর আরও কমছে। মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দিনে দুই বার পানি সরবারহ করা হয়। এছাড়া ৫৫টি উত্তোলক পাম্প প্রায় সারাদিনই চালু থাকে। ফলে এখন পানির খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি বলেন, গত ৫ বছরে খুলনায় ৩ ফিটের বেশি পানির লেয়ার নিচে নেমে গেছে। তবুও খুলনা ওয়াসা নগরবাসীর জন্য ১১ কোটি লিটারের বেশি পানি সরবরাহ করছে। খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল্লাহ বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার সমাধান এখনই দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও বেশি সময় পানির পাম্প চালিয়ে কিছুটা অতিরিক্ত পানি দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বাগেরহাট জেলার মোংলা পৌরসভার জয়বাংলা, মিয়াপাড়া, কলেজমোড়, সিগনাল টাওয়ার, কবরস্থান রোডসহ বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা জানান, মোংলা পৌরসভার পক্ষ থেকে শহরবাসীর জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এক কলস পানির জন্য ২-৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। সকাল ও বিকেলে সামান্য সময়ের জন্য পানি সরবরাহ চালু হলেও এর কয়েক ঘণ্টা আগে ভুক্তভোগীদের সিরিয়াল দিতে হয়। এক কলস পানির জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় তাদের। বিশুদ্ধ পানির সংকট থাকায় জনসাধারনের দুর্ভোগ চরমে স্বীকার করে পৌরসভার মেয়র শেখ আব্দুর রহমান বলেন, চাহিদা মেটাতে পানির প্রকল্পের আওতায় নতুন করে তৃতীয় ফেইসের কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রায় ৫০ কোটি টাকার নতুন এই ফেইসের অনুমোদন হলে পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। এ প্রকল্পের দ্রুত অনুমোদনের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আর্কষণের পাশাপাশি হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন। যশোরের শার্শা উপজেলা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, স্বাভাবিক সময়ে পানির স্তর মাটির ১৬ ফুট নিচে থাকে। কিন্তু উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় পানির স্তর বর্তমানে ২৫ থেকে ৪০ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপে পানি উঠছে না। চৈত্র বৈশাখ মাস এলেই উপজেলার বাগআঁচড়া, কায়বা, উলশী, পুটখালি, গোগা ইউনিয়নের প্রায় সবগুলো গ্রামের অধিকাংশ নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে। এ সময়টাতে গোটা যশোরেই পানির সংকট দেখা যায়। এবার মনে হয় সংকট অন্যবারের তুলনায় একটু বেশি। এলাকার জনসাধারণের কথা মাথায় নিয়ে সরকার প্রায় ৩শ সাবমার্সিবল পাম্প বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাত্র ১০ হাজার টাকায় সুবিধাভোগীদের মধ্যে পাম্পগুলো দেয়া হচ্ছে। যে কেউ সরকারের দেয়া এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে বলে তিনি জানান।
এ ব্যাপারে শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা জানান, চলতি বোরো মৌসুমে গভীর এবং অগভীর নলকূপের মাধ্যমে জমিতে সেচ দেয়ার কারণে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। স্থানীয়ভাবে খাল বিল তালিকাভুক্তির কাজ চলছে। জেলা প্রশাসকের কাছে এগুলো খনন করার প্রস্তাব পাঠানো হবে। নদী ও খালে পানি ধরে রাখতে পারলে এবং ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে পারলে সেচ মৌসুমে পানির নিচের স্তর ধরে রাখা সম্ভব হবে। এদিকে ২০০৯ সালে আইলার তাণ্ডবের পর থেকে সুপেয় পানির সংকট সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ জুড়ে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে নষ্ট হয়ে গেছে সুপেয় পানির উৎস। বিকল্প হিসেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও পুকুরের পানি ফিল্টারিং করে ব্যবহার করতেন উপকূলীয় এলাকার মানুষ। তবে সম্প্রতি খোলপেটুয়া নদীর দূর্গাবাটি বেড়িবাঁধ ভেঙে লোনা পানি লোকালয়ে ঢুকেছে। ফলে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছেন। সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী আরশেদ আলী জানান, উপকূলীয় এলাকায় ভূগর্ভস্থ মিষ্টি পানি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। পুকুরের পানি ফিল্টারিং করে সরবরাহ করা হয় মানুষদের। তবে ঘন ঘন বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ করে আশাশুনি ও শ্যামনগরে সুপেয় পানির খুব সংকট। তাই রেইন হার্ভেস্টিং ওয়াটারই ভরসা। যেটা পিএসএফের মাধ্যমে বিশুদ্ধ করে জনগণকে দেয়া হয়।
সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার বলেন, বুড়িগোয়ালিনী এলাকায় খাবার পানির সংকট নিরসনে একটি পানির প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। তবে অন্যান্য জায়গায় সুপেয় পানির সংকট নিরসনে তিনি উপজেলা প্রশাসনকে সাথে নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। শুধু শ্যামনগর ও আশাশুনি নয়, সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে পুরো জেলা। জেলার প্রায় ৫০ ভাগেরও বেশি মানুষ সুপেয় পানি পান করতে পারছেন না। সংস্কারের অভাবে উপকুলীয় এলাকায় সরকারিভাবে বসানো ৬৫০টি পিএসএফের অধিকাংশ অকেজো হয়ে পড়েছে। অপরদিকে জেলা পরিষদের অধীনে ৭৩টি পুকুর পুনঃখনন করা হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আকমল হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশগত নানা সমস্যায় উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে। আইলার আগে এই এলাকায় এতটা পানির সংকট ছিল না। কিন্তু আইলার প্রলয়ে সুপেয় পানির সবগুলো আধার লবণ পানিতে ডুবে যায়। সেগুলো থেকে এখন আর লবণ পানি সরানো যাচ্ছে না। ফলে মিঠা পানির সংকট দিন দিন বাড়ছে। তিনি বলেন, উপকূলীয় এলাকার পানি সমস্যা সমাধানে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে এবং এই পানি প্রতিটি পরিবারের জন্য সহজলভ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চল্লিশটি পুকুর খনন করা হচ্ছে। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য সাড়ে ৫ হাজার সংরক্ষণাগার তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় এলাকায় গভীর ও অগভীর নলকূপের ব্যবস্থা থাকছে।