উড়ে এলো প্রেম, হারিয়ে গেল ৩৪ বছর পরে, কঠিন এক রহস্য

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ নিউ ইয়র্কে ১৯৮৭ সালের একটি ব্যবসায়িক নৈশভোজের অনুষ্ঠান। তাতে একটি টেবিলে পাশাপাশি মাত্র দুটি আসন খালি। একটিতে গিয়ে বসলেন মেলিন্ডা অ্যান ফ্রেঞ্চ। এর দু’চার মিনিটের মধ্যে ফাঁকা আসনে গিয়ে বসলেন বিল গেটস। পাশাপাশি, খুব পাশাপাশি বসা মেলিন্ডা আর বিল গেটস। মেলিন্ডা তারই প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের একজন প্রজেক্ট ম্যানেজার। কোথা থেকে যেন প্রেম উড়ে এলো। বিল গেটস তার দিকে তাকালেন অন্যচোখে।
ভাল লেগে গেল মেলিন্ডাকে। ভাল লাগলো মানে, একেবারে হৃদয়ে গেঁথে গেল। সেই থেকে দু’জনের প্রেম। চুটিয়ে প্রেম। এক বছর প্রেম করার পর বিল গেটস কিছু প্রস্তাবনার তালিকা তৈরি করলেন। বিয়ে করলে কি কি হবে, তার একটি তালিকা। টানা ৭টি বছর তারা প্রেমে হাবুডুবু খেলেন। এরপর ১৯৯৪ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন তারা। মেলিন্ডা অ্যান ফ্রেঞ্চ হয়ে গেলেন মেলিন্ডা গেটস। তারপর থেকে সুখে-দুঃখে একসঙ্গে কেটে গেছে দীর্ঘ ২৭টি বছর। সব মিলে তাদের প্রেম ও দাম্পত্য জীবন নিয়ে কেটে গেছে ৩৪টি বছর। এ সময়ে তারা তিনটি সন্তানের পিতামাতা হয়েছেন। বড়মেয়ে জেনিফারের বয়স এখন ২৫ বছর। এরপরে রয়েছে ছেলে রোরি (২১) এবং ১৮ বছর বয়সী মেয়ে ফোইবি (১৮)। ভরপুর সংসার, হাসিখুশি মাখা সন্তান, অর্থবিত্তে সয়লাব পরিবার, দাতা হিসেবে ব্যাপক সুনাম বিশ্বজুড়ে, দাতব্য সংস্থা পরিচালনায় আছে সুনাম। তারপরও এত বছর পরে বিচ্ছেদের ঘোষণা দিলেন বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটস। কিন্তু কেন? কি রহস্য এই বিচ্ছেদের? এর কোনো কুলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। অ্যামাজন বস জেফ বেজোসের সংসার ভেঙেছে লঁরা সানচেজ নামে এক যুবতীর সঙ্গে গোপন প্রেমের কারণে। কিন্তু মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ও তার স্ত্রী মেলিন্ডা গেটসের সংসার ভাঙছে কি কারণে, তা কঠিন এক রহস্যে ঘেরা। যার চোখে চোখ রেখে বিল গেটস দেখেছিলেন তার ভালবাসার স্বর্গ, তার সঙ্গেই ২৭ বছর সংসার করার পর দু’জনেই বিচ্ছেদের ঘোষণা দিলেন! এ খবরে বিশ্বজুড়ে তুমুল আগ্রহ। পশ্চিমা সব অনলাইন বা প্রিন্ট ভার্সনের পত্রিকায় প্রধান সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠে এসেছেন তারা। সবাই জানার চেষ্টা করছে কি কারণে এই বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। তবে এর আগে এক সাক্ষাৎকারে মেলিন্ডা বলেছিলেন, নিজের কাজ এবং পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে ভীষণ সমস্যা হচ্ছে তার স্বামী বিল গেটসের।
সোমবার তারা ২৭ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটানোর ঘোষণা দেন। আকস্মিক এ ঘোষণায় বিস্মিত মানুষ। তাদের সন্তানদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। তবু বিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে ভেঙে গেছে বলে ঘোষণা দিয়েছেন মেলিন্ডা। তিনি বিচ্ছেদ আবেদন করে দরখাস্ত করেছেন। এতে বলেছেন, তিনি এবং বিশ্বে চতুর্থ শীর্ষ ধনী মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে বিয়ের আগে কোনো লিখিত চুক্তি হয়নি। ফলে এই দম্পতির গড়ে তোলা প্রায় ১৩০০০ কোটি ডলার কিভাবে ভাগ হবে তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। বিল গেটসের বয়স এখন ৬৪ বছর। মেলিন্ডা ৫৬। আদালতে তারা যে আবেদন জমা দিয়েছেন তাতেই দেখা গেছে যদি বিচ্ছেদ হয় তাহলে সম্পদ তাদের মধ্যে কিভাবে ভাগ হবে সে সম্পর্কে কোনো চুক্তি নেই। উল্লেখ্য, এই দম্পতির রয়েছে ৫টি এস্টেট, একটি প্রাইভেট জেট, বিস্ময়কর সব আর্ট কলেকশন এবং বিলাসবহুল গাড়ির ভা-ার। বড়মেয়ে জেনিফার গেটস (২৫) জানিয়েছেন তার পরিবার কঠিন এক হতাশাজনক চ্যালেঞ্জিং সময় পাড় করছে। এরপরই মেলিন্ডা গেটসের বিচ্ছেদের আবেদন আলোর মুখ দেখে। সোমবার স্থানীয় সময় বিকেলে ইন্সটাগ্রামে পিতামাতার বিচ্ছেদের ঘোষণা নিয়ে তিনি হতাশার কথা লিখেছেন।
বিল গেটস এবং মেলিন্ডা দু’জনেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে তাদের বিচ্ছেদের যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করেছেন। এতে তারা লিখেছেন, অনেক চিন্তাভাবনা এবং অনেক বিষয়ে কাজ করে আমরা সিদ্ধান্তে এসেছি বিবাহ বিচ্ছেদের। এতে তারা আরো লিখেছেন, ২৭টি বছর ধরে আমরা বড় করেছি অসাধারণ তিনটি সন্তানকে। গড়ে তুলেছি একটি ফাউন্ডেশন। এটি সারা বিশ্বে মানুষকে সুস্থ এবং উৎপাদনক্ষম জীবন যাপনে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এই মিশন সম্পর্কে আমাদের অভিন্ন বিশ্বাস রয়েছে। তা হলো, আমাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও একসঙ্গে অব্যাহতভাবে এই ফাউন্ডেশনের জন্য কাজ করে যাবো। কিন্তু আমরা জীবনের বাকিটা অংশ একসঙ্গে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কাটাতে পারবো না। আমাদের পরিবার এবং এর গোপনীয়তা অটুট রেখে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। বিল এবং মেলিন্ডার মধ্যে সর্বশেষ দু’সপ্তাহেরও কম সময় আগে জনসমক্ষে একত্রে দেখা গেছে। এ সময় তারা স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা বিষয়ক একটি ইভেন্টে ভাচ্যুয়ালি অংশ নিচ্ছিলেন।
বিল গেটস ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মাইক্রোসফট। এর মধ্য দিয়ে ১৯৮৭ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী বিলিয়নিয়ার হন। এ বছরেই নিউ ইয়র্কে এক ব্যবসায়িক অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎ হয় নিজের কোম্পানিতে চাকরি করা মেলিন্ডার সঙ্গে। বিল গেটস তখন মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এর ৬ বছর পরে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহিত জীবন কাটিয়েছেন কোয়ার্টার সেঞ্চুরিরও বেশি সময়। তারপর কেন এই বয়সে এসে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে হচ্ছে তা অজানা। সোমবার ওয়াশিংটনের কিং কাউন্টিতে সুপ্রিম কোর্টে বিচ্ছেদের আবেদন জমা দিয়েছেন মেলিন্ডা। এতে তিনি বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেদিন থেকে ‘আমাদের বিচ্ছেদের চুক্তি হয়েছে’ সেদিন থেকে এই বিয়ে বিচ্ছেদকে কার্যকর হিসেবে ধরার জন্য। তবে এই আবেদনে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হবে হয়েছে, সেই তারিখটি পরিষ্কার নয়। বিয়ের আগে যদি সম্পত্তি ভাগাভাগির কোনো চুক্তি না থাকে, তখন বিবাহ বিচ্ছেদের চুক্তি বা কন্ট্রাক্টকে চুক্তি হিসেবে ধরা হয়। এই আবেদনে মেলিন্ডা ভরণপোষণের কোনো সাপোর্ট দাবি করেননি। ফলে তাদের বিয়ে বিচ্ছেদের বিষয়টি ট্র্যায়াল ছাড়াই সম্পন্ন হতে পারে।
প্রথম প্রেমের সেই সময়কে স্মরণ করে ২০১৯ সালে নিজের জীবনী ‘দ্য মোমেন্ট অব লিফট’-এ মেলিন্ডা বর্ণনা করেছেন তাদের প্রেমের প্রথম সেই মুহূর্তকে। অন্যদিকে নেটফ্লিক্স ডকুমেন্টারিতে নিজের জীবন সম্পর্কে বিল বলেছেন, আপনি জানেন, আমরা একে অন্যের খুব যত্ন নিই। সে যা-ই হোক, ১৯৯৪ সালে লানাইয়ের হাওয়াই দ্বীপে একটি গলফ কোর্সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এই দুনিয়াজোড়া খ্যাতিমানরা। এর দু’বছর পরেই তাদের প্রথম সন্তান জেনিফার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯৬ সালে। ২০১৯ সালে তাদের বিবাহের রজতজয়ন্তীর অল্প পরে মেলিন্ডা দ্য সানডে টাইমসকে একটি বিরল সাক্ষাৎকার দেন। এতে তিনি বলেন, কাজ আর সংসার এই দুটির মধ্যে সমতা রক্ষা করতে একরকম লড়াই করছেন বিল। তার ভাষায়- বিশ্বাস করুন এমন কিছু দিন আছে আমাদের দাম্পত্য জীবনে, তা অসম্ভব কঠিন। সেখানে আপনাকে ভাবতে হবে আমি কি এটা করতে পারি? এ বছরেই প্রকাশিত হয় তার স্মৃতিকথা। তাতে একজন পাবলিক আইকনের স্ত্রী হিসেবে এবং একই সঙ্গে তিনটি সন্তানের মা হিসেবে বাসায় অবস্থান করার মধ্যে একরকম ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজেকে লড়াই করতে হয়েছে।
১৯৭৫ সালে পল অ্যালেনকে সঙ্গে নিয়ে মাইক্রোসফ প্রতিষ্ঠা করেন বিল গেটস। ২০০০ সাল নাগাদ এখানে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর পরিচালকের ভূমিকায় চলে যান। আস্তে আস্তে সমাজহিতৈষী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত বছর তিনি মাইক্রোসফটের পরিচালনা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। একই সঙ্গে পদত্যাগ করেন বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে থেকে ।
১৯৬৪ সালে টেক্সাসের ডালাসে একজন এরোস্পেস প্রকৌশলী এবং একজন গৃহবধূর কন্যা হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন মেলিন্ডা অ্যান ফ্রেঞ্চ। ১৯৮৭ সালে মাইক্রোসফটে যোগ দেয়ার আগে নর্থক্যারোলাইনার অভিজাত ডিউক ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। বিল গেটস বড় হয়েছেন সিয়াটলে। তার জন্ম ১৯৫৫ সালে। তার পিতা একজন সুপরিচিত আইনজীবী। আর মা ফাইন্যান্স হোল্ডিং কোম্পানির পরিচালনা পরিষদে দায়িত্ব পালন করেন। বিল গেটসের পড়াশোনা ভাল লাগলো না। তিনি ১৯৭৫ সালে মাইক্রোসফট চালু করবেন বলে হার্ভার্ডের পড়াশোনা বাদ দেন।
বিচ্ছেদ আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত করতে দু’জনেই আইনজীবীদের পাওয়ার হাউজ বলে পরিচিত এমন প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া করেছেন। মেলিন্ডার প্রতিনিধিত্ব করছেন নিউ ইয়র্কভিত্তিক এটর্নিরা। তারা হলো কোহেন ক্লেয়ার লেন গ্রিফেফার থর্প অ্যান্ড রোটেনসট্রিচ এলএলপি এবং পল, ওয়েইস, রিফকাইন্ড, ওয়ারর্টন অ্যাল্ড গ্যারিসন এলএলপি’র আইনজীবী। অন্যদিকে বিল গেটসের প্রতিনিধিত্ব করবেন লস অ্যানজেলেস ভিত্তিক তিনজন আইনজীবী। তারা মাঙ্গার টোলস অ্যান্ড ওলসনের আইনজীবী। এর মধ্যে একজন আইনজীবী চার্লস টি মাঙ্গার বিল গেটসের বিলিয়নিয়ার বন্ধু ওয়ারেন বাফেটের দীর্ঘদিনের অংশীদার।