ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা ১৫ হাজার কোটি টাকা কমার শঙ্কা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। এক মাস রোজা রাখার পর নতুন পোশাকে ঈদ আনন্দে মেতে ওঠেন সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। শুধু উৎসব নয়, অর্থনীতি চাঙ্গা করতেও বড় ভূমিকা রাখে ঈদুল ফিতর। ফলে ব্যবসায়ীদের বড় অংশই বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকেন এই ঈদের।
বছর ঘুরে আবার ঈদুল ফিতর এলেও মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রকোপে সব কিছুই যেন ওলট-পালট করে দিচ্ছে। করোনা প্রকোপের মধ্যে ঈদ সামনে রেখে মার্কেট খোলা হলেও এবার বিক্রি অর্ধেকের নিচে নেমে আসার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে এবার ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো কমে যেতে পরে বলে ধারণা করছেন তারা।
ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর রোজার ঈদের অপেক্ষায় থাকেন। কারণ সারাবছর যে ব্যবসা হয়, তার বড় অংশই আসে এই ঈদের সময়। আমাদের হিসাবে স্বাভাবিক সময়ে রোজার ঈদকেন্দ্রিক বিক্রির পরিমাণ হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এবার এর অর্ধেকও হবে বলে মনে হচ্ছে না
ব্যবসায়ীদের অভিমত, এক মাস রোজা রাখার পর ঈদকে রাঙিয়ে দিতে প্রতিবছর নিজের ও পরিবারের পছন্দের পোশাক কেনেন ধনী-গরিব সব শ্রেণী পেশার মানুষ। ফলে বছরের বিক্রির বড় একটি অংশ হয়ে থাকে ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদে। স্বাভাবিক সময়ে রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে পোশাকের বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু করোনার কারণে এবার মার্কেটে ক্রেতা আসছেন না , যে কারণে বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।
তারা বলছেন, গত বছর করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা ঠিকমত বিক্রি করতে পারেননি। ফলে বড় লোকসান গুনতে হয়েছে তাদের। গত বছরের তুলনায় এবার করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভয় তুলনামূলক কম। কিন্তু তারপরও ঈদকেন্দ্রিক বিক্রির পরিস্থিতি ভালো নয়। এবারও ব্যবসায়ীদের মুনাফা করার সম্ভাবনা খুবই কম।
আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দোকান খুলছি। যতটুকু সম্ভব ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি না করার চেষ্টা করছি। সীমিত লাভে পণ্য বিক্রি করে দিচ্ছি। দুপুরের দিকে কিছু ক্রেতা আসেন। কিন্তু বিকেলের পর ক্রেতা তেমন একটা থাকে না
এ বিষয়ে সোমবার (৩ মে) বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর রোজার ঈদের অপেক্ষায় থাকেন। কারণ সারাবছর যে ব্যবসা হয়, তার বড় অংশই আসে এই ঈদের সময়। আমাদের হিসাবে স্বাভাবিক সময়ে রোজার ঈদকেন্দ্রিক বিক্রির পরিমাণ হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এবার এর অর্ধেকও হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
এবার ঈদকেন্দ্রিক কী পরিমাণ ব্যবসা হতে পারে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। আর এক সপ্তাহ গেলে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। তবে আমি মার্কেট ঘুরে ঘুরে দেখেছি। তাতে আমার মনে হয়েছে বিক্রি পরিস্থিতি খুবই খারাপ। মুনাফা তো দূরের কথা, মূলধন ওঠানোই ব্যবসায়ীদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিক্রি পরিস্থিতি খারাপ হলেও এবার বিক্রেতাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা বেশি। আমি বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখেছি ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ মাস্ক পারছেন। কিছু ক্ষেত্রে যে সমস্যা আছে আমার ধারণা এটাও থাকবে না।’
গত বছরের সঙ্গে এবারের বিক্রির পরিস্থিতি তুলনা করতে বললে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘গত বছর ১৫ রোজার পর মার্কেট খোলা হয়েছিল। করোনা নিয়েও মানুষের মধ্যে অনেক ভয় ছিল। সন্ধ্যার পরপরই মার্কেট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে গত বছরের ঈদ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে ব্যবসায়ীদের। এবারের পরিস্থিতি গত বছরের চেয়ে একটু ভালো। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে এবারের ব্যবসা পরিস্থিতি খুবই খারাপ।’
আমাদের ধারণা মার্কেট খোলার সময় বাড়িয়ে দিলে বিক্রি অনেক বেড়ে যাবে। ঈদের যেহেতু আর ১০ দিনও বাকি নেই, তাই এই কয়দিন মার্কেট খোলার সময় বাড়িয়ে রাত ১২টা করে দেয়া যেতে পারে। তাহলে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও লোকসান কমিয়ে আনতে পারবে
৮টার মধ্যে মার্কেট-দোকান বন্ধ করতে হয়। ফলে ক্রেতাদের যৎসামান্য উপস্থিতি ইফতারের আগেই দেখা যায়
ঈদ বাজারের কেনাকাটার মূল আকর্ষণ হিসেবে নতুন পোশাক থাকলেও জুতা, লেডিস ব্যাগ, মানিব্যাগ, স্বর্ণালঙ্কার ও ইমিটেশন, প্রসাধনী, বেল্ট, ফার্নিচার, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, গাড়িসহ বিভিন্ন পণ্যের বিক্রির পরিমাণও বহুগুণে বেড়ে যায়। তবে পোশাকের মতো এবার এসব পণ্যের বিক্রিতেও ভাটা পড়েছে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, ‘এবার আমাদের ঈদকেন্দ্রিক বিক্রি পরিস্থিতি খুবই খারাপ। করোনার কারণে মানুষ ঘর থেকে কম বের হচ্ছে এবং জরুরি পণ্যের বাইরে কেনাকাটাও করছে কম। স্বর্ণালঙ্কার কেনার বদলে অনেকে এখন বিক্রি করে দিচ্ছেন।’
ঈদকেন্দ্রিক বিক্রির পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে অ্যাপেক্স ফুটওয়ারের কোম্পানি সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘আমরা সারাবছর যে ব্যবসা করি তার ৩০-৪০ শতাংশই হয় পহেলা বৈশাখ ও রোজার ঈদে। করোনার কারণে গত বছরের মতো এবারও বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মার্কেট খোলার যে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে, তার জন্যও মানুষ কেনাকাটা করতে কম বের হচ্ছে। এছাড়া গণপরিবহন না চলাচল করারও একটা নেতিবাচক প্রভাব আছে বিক্রির ক্ষেত্রে।’
পোশাক ব্যবসায়ীদের অনেকের ধারণা, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এবার বিক্রি অর্ধেকেরও কম হবে। ফুটওয়ারখাতের কী অবস্থা? প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বিক্রি অর্ধেকের নিচে হবে, এটা হতেই পারে। তবে আমাদের বিক্রি পরিস্থিতি নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। চাঁদ রাত পর্যন্ত দেখা যাক কী হয়।’
এদিকে বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদকেন্দ্রিক মার্কেট খুলে দেয়ার পর আট দিন কেটে গেলেও ক্রেতাদের খুব একটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। দুপুরের দিকে ক্রেতাদের কিছু আনাগোনা থাকলেও বিকেলের মধ্যে কিছু মার্কেট ক্রেতাশূন্য হয়ে যাচ্ছে।’
নয়াপল্টনের পলওয়েল মার্কেটের ব্যবসায়ী সুমন বলেন, ‘আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দোকান খুলছি। যতটুকু সম্ভব ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি না করার চেষ্টা করছি। সীমিত লাভে পণ্য বিক্রি করে দিচ্ছি। দুপুরের দিকে কিছু ক্রেতা আসেন। কিন্তু বিকেলের পর ক্রেতা তেমন একটা থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘ক্রেতা কম হওয়ার অন্যতম কারণ মার্কেট খোলার বেঁধে দেয়া সময়। রোজার মাসে ক্রেতারা সাধারণত রাত ১২টা পর্যন্ত কেনাকাটা করেন। কিন্তু এখন ৮টার মধ্যে মার্কেট বন্ধ করতে হয়। ফলে ইফতারের পর ক্রেতা খুব একটা আসেন না।’
গত বছর খুব খারাপ পরিস্থিতি গেছে জানিয়ে সুমন বলেন, ‘এবার ভালো ব্যবসা হবে, এই আশায় নতুন করে ১০ লাখ টাকা ইনভেস্ট করেছি। কিন্তু বিক্রির যে পরিস্থিতি, এভাবে চললে ঈদ শেষে পাঁচ লাখ টাকার বিক্রিও হবে না।’
নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী আহসান বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার বিক্রি ভালো। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে এবার অর্ধেক বিক্রিও হচ্ছে না। তবে আমাদের ধারণা মার্কেট খোলার সময় বাড়িয়ে দিলে বিক্রি অনেক বেড়ে যাবে। ঈদের যেহেতু আর ১০ দিনও বাকি নেই, তাই এই কয়দিন মার্কেট খোলার সময় বাড়িয়ে রাত ১২টা করে দেয়া যেতে পারে। তাহলে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও লোকসান কমিয়ে আনতে পারবে।’
খিলগাঁও তালতলা সুপার মার্কেট বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুজ্জামান জুয়েল বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে যদি রোজার ঈদকেন্দ্রিক ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়, এবার তা ১৫ হাজার কোটি টাকার নিচে হবে। এবার মার্কেটের বিক্রি পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ঈদের আর বেশি বাকি নেই, কিন্তু মার্কেটে ক্রেতা খুব একটা আসছেন না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মার্কেটের ক্রেতাদের বড় অংশ নিম্ন আয়ের মানুষ। স্বাভাবিক সময়ে ঈদের ১০-১৫ দিন আগে থেকে মার্কেটে ক্রেতাদের ভিড়ে হাঁটা যায় না। কিন্তু এবার ক্রেতাই নেই। এমনকি গত বছরের তুলনায়ও এবার ক্রেতা কম।’