জীবিকা সহায়ক বাজেট চাই

0

করোনার কবলে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যন্ত। অনেক দেশে দ্বিতীয় কোথাও তৃতীয় ঢেউ চলছে। আমাদের দেশে গত বছর ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তখনো বৈশ্বিক অতিমারীর নানা প্রতিকূলতায় দেশের ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়েছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার। বাজেটের শিরোনাম ছিল অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা।
গত আগস্টের দিকে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমতে থাকলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। দেশের কৃষি, রেমিট্যান্স ও সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা ভূমিকা পালন করলেও এ বছর মার্চের প্রথম দিন থেকে ফের করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকে। ফলে জীবন ও জীবিকা নিয়ে সবাই শঙ্কায় আছেন। চলছে সরকার ঘোষিত লকডাউন। এরই মধ্যে আগামী জুনে আসছে নতুন বাজেট। বাজেটের খসড়া তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে ৫ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক ধারণা দিয়েছে, অর্থনীতি যদি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৩ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পরিস্থিতি ও রেমিট্যান্সের উচ্চপ্রবাহে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠলে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (এসক্যাপ) পূর্বাভাস দিয়েছিল, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। যেখানে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এ প্রবৃদ্ধির চিত্র কি হবে তার চেয়ে বড় চিন্তা মানুষের জীবন ও জীবিকার হাল কি হয়। তাই আসন্ন বাজেটে জীবন রক্ষায় যা যা করণীয় তার প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অর্থনীতিকে আবার অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে। তাই এবারের বাজেট প্রণয়ন অনেক গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। কোভিডকে মাথায় রেখে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনৈতিক চাহিদা, দেশীয় শিল্পের উন্নয়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে মাথায় রেখে এই বিশেষ সময়ে বিশেষ বাজেট তৈরি করা দরকার।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ছিল গতানুগতিক। সাধারণ মানুষের উন্নয়নে এ বাজেট তেমন কিছু ছিল না। তাই ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে জীবন রক্ষা ও ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে আনুষ্ঠানিক উত্তরণের বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি যেমন- কৃষি, ছোট বড় শিল্পখাত, প্রবাসী আয়, রফতানিখাত, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ সেবাখাতকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। চলতি বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ এ তা বেড়ে হয় ৪৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে। চলমান বাজেটের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবাসী আয় হয়েছে- ১৬ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ বিগত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বিগত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। আসন্ন বাজেটে প্রবাসী আয়ের ঊর্ধ্বমুখীধারা রক্ষা করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্বজুড়ে কোভিডের ধাক্কায় জনশক্তি রফতানির অবস্থা ভালো নয়। বাজেটে জনশক্তি রফতানি তথা বিদেশে কর্মসংস্থানে জোর দেয়া আবশ্যক। শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়া সহজ করা, তাদের মজুরি বৃদ্ধি ও দালালদের খপ্পর থেকে মুক্ত রাখা, সাহায্যকারী ব্যক্তিদের কিভাবে সহযোগিতা করা যায় সে বিষয়ে উল্লেখ থাকা চাই।
আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি থেকে আমাদের শিল্পের কাঁচামাল আসে। কৃষি উৎপাদন মানসম্মত ও টেকসই হলে খাদ্য চাহিদা পূরণসহ জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের চাহিদা পূরণ করা যায়। গত বছর করোনাকালীন অর্থনীতিতে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাই কৃষিতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। কৃষি ঋণের সুদহার কমাতে হবে। গ্রামের শিক্ষিত যুবকদের সুসংহত করতে গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলো মজবুত করা উচিত। বীজ সার কৃষি যন্ত্রপাতির দাম কমানোসহ কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোর দিতে হবে।
করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির কারণে লকডাউনে দোকান ও ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধের কারণে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে ফলে মানুষ ঘর থেকে কম বের হয়, কেনাকাটা কম হয়, মানুষের চাহিদা কমে যায়, উৎপাদন কমে যায় ফলে অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতে প্রণোদনার বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ রিফাইন্যান্সিং স্কিম চালু করেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এ ফান্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। বাজেটে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা চাই। এতে অনানুষ্ঠানিক খাতের উদ্যোক্তরাও যেন অন্তর্ভুক্ত থাকে।
আমাদের অভ্যন্তরীণ শিল্প ও বাণিজ্যিক খাত সুসংহত করা প্রয়োজন। আঞ্চলিক কানেকটিভিটি বাড়াতে হবে। এ ছাড়া আমাদের করপোরেট ট্যাক্সের হার অনেক বেশি। এ বিষয়ে ভাবা উচিত। রফতানিতে তৈরী পোশাক খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এ খাতে কর্মসংস্থান তৈরির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বিপুলসংখ্যক জনশক্তি এ খাতে কর্মে নিয়োজিত। এ খাতে কিভাবে বৈচিত্র্য আনা যায় বাজেটে সে বিষয়ে নির্দেশনা থাকা চাই। এ খাতের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও বেশি কার্যাদেশ পেতে বিদেশী ক্রেতাদের সাথে কিভাবে সম্পর্ক উন্নয়ন করা যায় সে বিষয়েও বেশি করে নজর রাখতে হবে। প্রয়োজনে এ খাতের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা উচিত। রফতানি বৃদ্ধি ও রফতানিমুখী শিল্পের উৎপাদন, বাজারজাতকরণসহ ভ্যাট, ট্যাক্সের ক্ষেত্রে নমনীয় দৃষ্টি বাজেটে থাকা চাই।
এবার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবাখাত স্বাস্থ্যের কথায় আসা যাক। করোনার কারণে এ খাতের দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা, সমস্যাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মানুষের জীবন রক্ষা, স্বাস্থ্যসম্পন্ন জাতি গঠনে এ খাতের উন্নয়ন অনস্বীকার্য। প্রতি অর্থবছরেই এ খাতের বরাদ্দ বাড়লেও শতকরা হিসাবে ৫ শতাংশের কাছাকাছিই থাকে। চলতি বাজেটে ৫ শতাংশের কিছু বেশি স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তা ছাড়া নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনাও দুর্নীতির কারণে এ খাতের বেহাল দশা। তাই আসন্ন বাজেটে এখাতের বরাদ্দ বাড়ানো সময়ের দাবি। হাসপাতালগুলোতে বেড সংখ্যা, আইসিইউ বাড়ানো, সরঞ্জামাদির দাম ও ভ্যাট কমানো এবং ডাক্তার ও নার্সদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টিও বাজেটে থাকা উচিত।
কোভিডের অভিঘাতে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। এ বছর মার্চ পর্যন্ত এর মধ্যে শহরে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ৫৯ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ৪৪ শতাংশ। করোনা যদি আরো চলমান থাকে তাহলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে। তাই বাজেটে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ অর্থ বরাদ্দ রাখা উচিত। দারিদ্র্যনিরসনে প্রতি বছর বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বড় বরাদ্দ থাকে। কিন্তু এ বরাদ্দে প্রচুর অপচয় হয়। এ অপচয় রোধে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা আরো বাড়ানো যায়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুত পুনরুজ্জীবিত করতে হলে হতদরিদ্র, কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন জনগোষ্ঠী এবং অনানুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিতদের সুরক্ষা দিতে বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি ও বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে বরাদ্দ দেয়া উচিত। জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রান্তিক মানুষের হাতে সরাসরি কিছু টাকা পৌঁছে দিতে হবে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, অর্থনীতির স্বাস্থ্য বাড়বে।
আসন্ন বাজেটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিত করতে হবে। আমাদের রাজস্ব আহরণ ভীষণভাবে অধোগতিতে। কিন্তু খরচ প্রচণ্ড পরিমাণে বেড়েছি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) আয়কর, ভ্যাট, শুল্কখাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের বেশি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। ঘাটতি পূরণে বাকি তিন মাস রাজস্ব আদায় করতে হবে আরো এক লাখ ৫৩ হাজার ১৯১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, যা প্রায় অসম্ভব। চলতি অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা একে অবাস্তব বলেছিলেন। আসন্ন বাজেটে যৌক্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে, যা আদায়যোগ্য। আসন্ন বাজেটে আয়ের উৎস বাড়াতে হলে করের আওতা বাড়াতে হবে। করের হার বাড়ানো যাবে না। রাজস্ব বোর্ডের কর আদায়ের ব্যবস্থা আরো আধুনিকায়ন করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অহেতুক প্রকল্প না রাখা। বছরের পর বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে খরচ বাড়ানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি।
সর্বোপরি আসন্ন বাজেটে মানুষের খাদ্য, কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা, চাকরি হারানো শ্রমিকদের জন্য নগদ সহায়তা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা প্যাকেজ ইত্যাদি বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে। করোনার প্রভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য দেখা দিচ্ছে। শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনলাইনে শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্য ও জটিলতা দেখা দিচ্ছে, অনলাইনে শিক্ষার সুযোগ যেন স্বল্প আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েরা নিতে পারে সেজন্য ডিজিটাল শিক্ষাসামগ্রী বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে দেয়ার ব্যবস্থা বাজেটে উল্লেখ থাকতে হবে।
সর্বশেষ বলব, প্রবৃদ্ধি বা ঘাটতি বাজেট নিয়ে দুর্ভাবনা না করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কি করে বাড়ানো যায়, স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা দূর করে জ্ঞানভিত্তিক, সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে জনবান্ধব, বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করা, যেখানে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার ওপর জোর দেয়া হবে।