ঝিনাইদহে সাত মাসে বৃষ্টি নেই হাজার হাজার নলকূপ পানিশূন্য

0

স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহ ॥ ঝিনাইদহে সাত মাস বৃষ্টির দেখা নেই। প্রচন্ড দাবদাহ আর অনাবৃষ্টির কারণে জেলার ৬টি উপজেলার মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, জলাশয়, পুকুর ও নদ-নদীর পানি শুকিয়ে গেছে। ফলে দেখা দিয়েছে গোসল ও সুপেয় পানির সঙ্কট। প্রচন্ড খরতাপে চারিদিকে যেন হাহাকার অবস্থা। এদিকে দখলদারদের আগ্রাসন, পলি জমে ভরাট হওয়াসহ নানা কারণে নদ-নদীগুলোর অস্তিত্ব এখন বিলীন হওয়ার পথে। নদী-নালার তলদেশ ভরাট ও শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে এখন ধান, তামাকসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করছেন এলাকার চাষিরা। দেখে মনে হবে নদীর তলদেশ যেন এখন বিস্তীর্ণ ফসলি ক্ষেত। এভাবে চলতে থাকলে একসময় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে বলছেন পরিবেশবাদীরা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহের মাঝ দিয়ে নবগঙ্গা, কুমার, বেগবতি, চিত্রা, কপোতাক্ষ, গড়াইসহ বেশকিছু নদ-নদী প্রবাহিত। তবে একমাত্র গড়াই বাদে সবই এখন মৃত। জেলায় নদ-নদীর সংখ্যা ১২টি। এসব নদ-নদীর দৈর্ঘ্য ৪৮৪ দশমিক ৯০ কিলোমিটার। এসব নদী একসময় নদীপাড়ের মানুষদের কৃষিকাজসহ জীবিকার প্রধান মাধ্যম ছিল। নদীতে চলাচল করতো বড় নৌকা ও জাহাজ। কলকাতার সাথে রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই অঞ্চলের জলপথ। কিন্তু কালের বিবর্তনে পাল্টে গেছে চিত্র। এখন আর নদীতে চলে না মালবাহী নৌকা। বর্ষা মৌসুমে কিছুটা পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে যায় এসব নদ-নদী। ফলে এখানকার জীববৈচিত্র রয়েছে হুমকির মুখে। অন্যদিকে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ঝিনাইদহে হাজার হাজার নলকূপে পানি উঠছে না। ফলে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে শুধুমাত্র শৈলকুপাতেই ৩০ হাজার নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। জেলার কিছু জায়গায় পানি মিললেও এ মাসের শুরুতে একেবারেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে অনেক নলকূপ। এছাড়া এই নদীগুলো স্থানীয়রা যে যার মতো দখল করে চাষ করছে। এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল প্রতিনিয়তই নদীপাড়ে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করছে। ফলে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে নদীর প্রশস্ত। এখানেই শেষ নয়। ময়লা-আবর্জনা ফেলে দূষিত করা হচ্ছে নদীর পানি। ঝিনাইদহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নবগঙ্গা নদী। এই নদীকে ঘিরেই জেলার নামকরণ হয়েছিল। কিন্তু খননের অভাবে এর অধিকাংশ জায়গা শুকিয়ে গেছে। কোথাও কিছুটা পানি থাকলেও দুই পাড় দখলের কারণে কমে গেছে প্রশস্ততা। জেলা সদরের উদয়পুর গ্রামের নদীর অংশে দেখা যায়, শুকিয়ে যাওয়া নদীর মাঝ দিয়ে যাতায়াতের পথ তৈরি করা হয়েছে। শুকিয়ে যাওয়া নদীর দুই পাড় দখল করে স্থানীয়রা ধান চাষ করেছেন। কেউবা লগিয়েছেন তামাক। অন্যদিকে নদীপাড়ের অবাধে বেড়ে ওঠা ঘাস ব্যবহৃত হচ্ছে গোখাদ্য হিসেবে। অথচ একসময় এ নদীর প্রশস্ততা ছিল ৩’শ মিটার। এদিকে চিত্রা নদীর কালীগঞ্জ উপজেলার মধুগঞ্জ বাজার এলাকা, বেগবতী নদীর বিষয়খালী বাজার অংশ, কুমার নদের গাড়াগঞ্জ অংশসহ প্রায় প্রতিটি নদীর ধারেই পড়েছে দখলদারদের থাবা। ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পক্ষ থেকে জেলা শহর সংলগ্ন নবগঙ্গা নদীর কিছু অংশ উচ্ছেদ করা হলেও কয়েকদিন পরেই অদৃশ্য কারণে থেমে যায় সে কার্যক্রম। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এর তালিকা অনুসারে, এখন বিভিন্ন নদ-নদীতে ৬৯টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে. তবে বাস্তবে এ সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। এছাড়া ১৯৯৩-১৯৯৪ অর্থ বছরের পর আর খনন করা হয়নি বিদ্যমান নদ-নদীর কোনো অংশ। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উদয়পুর গ্রামের মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, কয়েক বছর আগে কিছু লোক এসে নদী মেপেছিলেন। তখন তারা বলেছিলেন খনন করা হবে। এরপর আর কোনোদিন তাদের দেখা যায়নি। অপর বাসিন্দা বাবলু মন্ডল বলেন, মানুষ যে যার মতো পারছে সীমানা মেপে দখল করে নিচ্ছে। কেউ ধান লাগাচ্ছে, কেউ অন্য ফসল চাষ করছে। জেলা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কমিটির জেলা সভাপতি মাসুদ আহমেদ সনজু বলেন, পরিবেশ, নদী, পানি ও প্রাণী একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর কোনটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অপরটির ওপর প্রভাব পড়ে। ফলে পরিবেশের সার্বিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা দেখতে পারছি বর্তমান সময়ে নদীপাড়ের বাসিন্দারাই বেশি দখল উৎসবে মেতে উঠছে। তৈরি করছে নানা স্থাপনা। খননের অভাবে ভরাট হয়ে গেছে নদী। এতে পানির অন্যতম উৎস নদ-নদী, জলাশয় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
ঝিনাইদহ পাউবো’র উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাকির হোসাইন বলেন, নদ-নদীগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট খননের বিষয়ে বোর্ডে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। সেগুলো অনুমোদন হলেই কাজ শুরু করা হবে। আর দখলদার উচ্ছেদ কাজ সামনের দিনগুলোতে পর্যায়ক্রমে শুরু হবে।