সারা দিন আগুন জ্বলেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়: নিহত ২

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ হেফাজতের ডাকা হরতালের দিন রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরকারি অফিস, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, পুলিশ ফাঁড়ি, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ও অফিস, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন জ্বলেছে। বাদ যায়নি প্রেসকাবও। হেফাজতের কর্মী ও সমর্থকরা এ ধ্বংসযজ্ঞে জড়িত বলে জানা গেছে। এ দিন সরাইলে গুলিতে দু’জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
গতকাল রবিবার হরতাল চলাকালে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শহরের সরকার পাড়ার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন শোভনের বাড়িতে প্রথমে আগুন দেওয়া হয়। সেখানে ঘর, আসবাব, বড় ভাই আইনজীবীর ২০ বছরের নথিপত্র পুড়েছে।
প্রত্যদর্শীরা জানান, বেলা বাড়লে আশপাশের গ্রাম থেকে এসে এসব ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নেন হেফাজত সমর্থকরা। তারা শহরের বঙ্গবন্ধু স্কয়ার এলাকায় সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন পৌর মিলনায়তনের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গান পাউডার দিয়ে পুরো হলরুম জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় অনুষ্ঠানের জন্য আনা সাউন্ড সিস্টেম, চেয়ার-টেবিল-মঞ্চ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
মতিন সাউন্ডের মালিক আবদুল মতিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার চোখের সামনেই আমার সবকিছু আগুনে পুড়ে গেছে। আমি রা করতে পারিনি। আমার এখন পথে নামা ছাড়া আর উপায় নেই।
এরপর পৌর ভবনের তৃতীয়তলা পর্যন্ত গিয়ে আগুন দেওয়া হয়। পুড়ে যায় অফিসের সব সামগ্রী। পৌরসভার কয়েকটি গাড়িও পুড়ে যায়। আগুন দেওয়া হয় শহরের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে। সেখানে চলমান সরকারের উন্নয়ন মেলার পুরো প্যান্ডেল, শতাধিক সরকারি অফিসের স্টল পুড়ে যায়। ভয়াবহ আগুনে এ সময় এই চত্বরে থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আল মামুন সরকারের কার্যালয় পুড়ে যায়। জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়েও আগুন দেওয়া হয়।
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেলের বন্ধু হিসাবে পরিচিত জেনির একটি মার্কেটের সব দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দু’বার আগুন দেওয়া হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মুন্সেফ পাড়ার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আল মামুন সরকারের বাড়ি। এরপর আগুন লাগিয়ে ঘর ও গাড়ি পোড়ানো হয় পার্শ্ববর্তী বাগানবাড়িতে তার শ্বশুর বাড়িও।
আগুন দেওয়া হয়েছে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা তানভীর চৌধুরীর বাড়িতে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় শহরের পুরোনো জেলরোড এলাকায় সদর উপজেলা ভূমি অফিস। সেখানে ভূমি সংক্রান্ত মূল্যবান নথি পুড়ে গেছে বলে জানান অফিসের কর্মচারীরা।
একই সময়ে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয় জেলা পরিষদে থাকা শিশু একাডেমির ভবন। তাণ্ডব চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় জেলা শিল্পকলা একাডেমি, সরকারি গণগ্রন্থাগার, ব্যাংক এশিয়া অফিস, শহরের দণি মৌড়াইলে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেলের বাড়ি। দুপুরের পর শহরের পাইকপাড়ায় পৌর মেয়র মিসেস নায়ার কবীরের বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করতে ব্যর্থ হয়ে তারা বাড়ির নিচে ‘আমার বাজার’ নামে একটি সুপারশপ লুটে নিয়ে যায়। সরকারি গণগ্রন্থাগারে হামলার সময় মারধর করা হয় সহকারী লাইব্রেরিয়ান সাইফুর রহমান লিমন ও মাথা ফাটানো হয় অফিস সহায়ক শাহাদাতের (৪৫)।
এ ছাড়া হেফাজত সমর্থকরা আশুগঞ্জে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক আবু নাসেরের বাড়িও ভাঙচুর করেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। সারা দিন ধোঁয়া উঠেছে শহরজুড়ে। মনে হয়েছে জ্বলছে পুরো শহর। রবিবার পুরো শহর ছিল কার্যত ধ্বংসের নগরী। তবে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীকে কোথাও হেফাজত সমর্থকদের ধ্বংসলীলা থামাতে দেখা যায়নি। হেফাজত সমর্থকদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে এবার রা পায়নি প্রেসকাবও। রবিবার সকাল সাড়ে ১১টার পরই একটি মিছিল নিয়ে এসে হেফাজত সমর্থকরা প্রেসকাবে ইট-পাটকেল নিপে করে ভাঙচুর করে।সকালে চট্টগ্রামগামী বিরতিহীন ট্রেন সোনার বাংলায় বিােভকারীরা হামলা করেন। এ সময় ইটপাটকেলের আঘাতে ট্রেনের বিভিন্ন বগির জানালা ও ইঞ্জিনের সামনের কাচ ভেঙে যায়। রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, রোববার সকালে রাজধানী ঢাকা থেকে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে। পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তালশহর স্টেশন এলাকা অতিক্রম করার সময় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী ও তাদের সমর্থকরা ট্রেনটি ল করে ইটপাটকেল ছোড়ে। এতে ট্রেনটির ইঞ্জিন ও বগি তিগ্রস্ত হয়। পরে যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ট্রেনটি উল্টো পথে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে নিয়ে যাওয়া হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হোসেন রেজা বলেন, আজকের পরিস্থিতি আপনারা নিজেরাই দেখছেন। জনগণের জানমালের রায় আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এসব তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত, শিবির ও বিএনপি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে রবিবার হেফাজতে ইসলামের হরতালকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর দুটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত দু’জনের একজন হলেন সদর উপজেলার বুধল ইউনিয়নের খাটিহাতা গ্রামের আলতাব আলী ওরফে আলতু মিয়া ওরফে কালন মিয়া (২৩) ও সরাইল উপজেলা সদরের কুট্টাপাড়া গ্রামের সুফি আলীর ছেলে আল আমীন (১২)। আহত অবস্থায় জেলা সদর হাসপাতালে নেয়ার আধা ঘণ্টা পর তিনি মারা যান। কুট্টাপাড়া গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সাদেক মিয়া ও প্রতিবেশী স্কুলশিক আল এমরান এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। নিহত ব্যক্তির বড় ভাই মাওলানা আবদুর রহিম (৩৮)বলেন, ‘আমার ভাই পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছে। লাশ আমাদের বাড়িতে আছে।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা রানা নুরুশামস হাসপাতালে শিশু আল আমীনের মৃত্যুর খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন। পুলিশ ও প্রত্যদর্শীরা বলেন, রবিবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সরাইল বিশ্বরোড মোড়ে খাটিহাতা হাইওয়ে থানায় হামলা করেন হরতাল–সমর্থকেরা। তারা থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। হেফাজত সমর্থকদের হামলায় ওসি শাখাওয়াত হোসেনসহ পাঁচজন আহত হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (সরাইল সার্কেল) আনিছুর রহমান বলেন, সরাইল উপজেলায় উত্তপ্ত অবস্থা থাকলেও মহাসড়ক ছাড়া কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। হাইওয়ে থানায় হামলায় অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।