এটাও দেখতে হলো!

0
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে বাংলাদেশ। সরকারিভাবে ১৭ থেকে ২৬ মার্চ বিদেশি অতিথিদের নিয়ে পালন করা হলো স্বাধীনতা উৎসব, সাথে মুজিব জন্মশতবার্ষিকী। একে একে এসেছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট, শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী, নেপালের প্রেসিডেন্ট, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী। এই পর্যন্ত সবকিছু ভালই চলছিল। বীভৎস জ্যামের শহর ঢাকাতে রাস্তা বন্ধ করে গুটিকয় মানুষের উৎসব পালন ঢাকাবাসীকে আরেকটু নাকাল করেছিল সত্য, কিন্তু তার বেশী কিছু না। বিপত্তি বাধলো ২৬ শে মার্চ নিয়ে। ২৬ শে মার্চ সকালে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে আসলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদি আসার কিছুদিন আগে থেকেই ক্ষণে ক্ষণে প্রতিবাদে মুখর হচ্ছিল ঢাকা। ডান-বামের এমন মেলবন্ধন সচরাচর দেখা যায় না। অবশ্য মোদি আসা উপলক্ষ্যে করা প্রতিটি প্রতিবাদই সরকার শক্তভাবে দমন করেছে, যেভাবে তারা করে থাকে সবসময়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসার বিরোধীতায় সবচেয়ে শক্ত প্রতিবাদটি হয়েছিল তার আসার দিনে ২৬ মার্চ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে। সেদিন বায়তুল মোকাররম, হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। পুলিশের সাথে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনী মিলে এক রকম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রতিবাদমুখর মানুষের ওপর। এর আগেও ২৪ ও ২৫শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহবাগ এলাকায় একই দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ সমাবেশ এবং মিছিলে ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছিল। এরাই হেলমেট পরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে রাস্তায় নামা শিশুদের ওপর।
যে কোনো ইস্যুতে জনগণের প্রতিবাদের অধিকার নিয়ে আলোচনায় পরে আসছি, আপাতত আলোচনার খাতিরে ধরে নেই এসব প্রতিবাদে সত্যিই রাষ্ট্রের খুব বড় ক্ষতি হচ্ছিল। যদি সেটাই হয়ে থাকে তাহলে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তো রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী আছে। এসব সমাবেশ-মিছিলে ছাত্রলীগ-যুবলীগের পাণ্ডারা হামলা করছে কেন? তাদের এমন ‘দায়িত্ব পালন’ কি ফৌজদারি অপরাধ নয়? এমন দায়িত্ব তাদেরকে দিয়েছে কে? দেশে কি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সমান্তরাল আর একটি ক্যাডারবাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে এই দেশের মানুষকে সময় সময় শায়েস্তা করার জন্য? একটা রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে বড় অশনিসংকেত আর কি হতে পারে? বিভিন্ন কারণে এদেশের সাধারণ মানুষের ভারতের প্রতি এবং বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি এবং তার দলের প্রতি বিতৃষ্ণা আছে। এমনকি তার নিজের দেশ ভারতের মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই তাকে নিয়ে আছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এমনকি আছে তীব্র প্রতিবাদের ঘটনাও। ২০২০ সালেই দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মোদির ক্যাম্পাসে আগমন প্রতিহত করার জন্য তীব্র আন্দোলন করেছিল। শুধু ভারতেই না, বিজেপির মুসলিমবিরোধী রাজনীতি, ঘৃণা ছড়ানো, বিভাজন এবং দুরত্ব তৈরি পৃথিবীর গণতন্ত্রপ্রেমী মানবতাবাদী কোনো মানুষই ভালো চোখে দেখেনি। নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করা, প্রতিবাদ করা, মানুষের জন্মগত অধিকার। এমনকি কিছু বিধিনিষেধ সাপেক্ষে সংবিধানও মানুষকে এই অধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসার আগে থেকে যে প্রতিবাদ চলছিল, এমনকি তার আসার দিন বায়তুল মোকাররমে যে প্রতিবাদ মিছিলের প্রস্তুতি চলছিল, তাতে আর যাই হোক মোদির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার ন্যুনতম কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তারপরেও সরকারের এই যুদ্ধংদেহি মূর্তি তাদের ভীতি এবং অসহিষ্ণুতাই প্রমাণ করে।
গত কয়েক বছর জবাবদিহিতাহীনভাবে পুলিশ, প্রশাসন আর ক্যাডারবাহিনী ব্যবহার করে সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন, প্রতিবাদ দমন করার ফল হয়েছে সরকার এখন এর বাইরে আর কিছু ভাবতে পারে না। প্রতিবাদের কোনো ভাষা তা যত গণতান্ত্রিকই হোক না কেন, সরকারের পক্ষে এখন তা মানা আর কোনোভাবেই সম্ভব না। আজকে যদি পুলিশ আর ক্যাডারবাহিনী ব্যবহার করে বায়তুল মোকাররমকে রণক্ষেত্রে পরিণত করা না হতো তাহলে হাটহাজারী কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়াও উত্তাল হয় না। স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে হাটহাজারীতেই নিহত হয়েছেন চার জন, আর ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে একজন। গুরুতর আহতদের যে সংখ্যার কথা জানা যাচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে তাতে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এই সরকারের সময় অতীতেও দেখেছি মাদ্রাসা ছাত্রদের ওপর হামলা, দেখেছি রক্তপাত। হয়তো খুব সহজ তাদের মেরে ফেলা, হয়তো সরকার ভাবে এমন দুই-চারটা লাশের হিসেব তাদের না দিলেও চলবে।
এই রাষ্ট্র টিকে থাকলে স্বাধীনতা দিবস আসবে আরও, কিন্তু সুবর্ণজয়ন্তী আসবে না আর। কেমন হবার কথা ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী? এটি হয়ে ওঠার কথা ছিল দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে এক প্রাণের উৎসব। কথা ছিল প্রতিটি রাজনৈতিক দল তার মতো করে কর্মসূচি পালন করবে, আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করবে নানা অনুষ্ঠানের। কথা ছিল আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা পতাকার রঙে রঙিন নানা রকম সাজে নেমে আসবে রাস্তায়, খাবে আর উপভোগ করবে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই দেশের স্বাধীনতা তো কারো দান নয়। ৩০ লক্ষ প্রাণ আর ২ লক্ষ মা-বোনের নির্যাতিত হবার বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা, লাল সবুজের পতাকা তার মালিকানা কোনো একক দল, গোষ্ঠী বা মতাদর্শের মানুষের নয়। দেশের কৃষক, শ্রমিক, কুলি, কামার,মজুর সবার রক্ত-ঘামের দাগ আছে এই পতাকায় আর আছে সমান অংশীদারিত্ব। আর তাই স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের। এত বছর নানান বঞ্চনার পরও এই দিনগুলো ছিল সাধারণ মানুষের, এবার আর তা রইলো না। এই লেখা যখন লিখছি তখন ফেসবুকে ঢোকা যাচ্ছে না। দেশের বেশ কিছু এলাকায় দ্রুত গতির ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার কথা সরকারই জানিয়েছে। অর্থাৎ সরকার চাইছে না মানুষ তার ঘটানো বীভৎসতা নিয়ে জানুক এবং অন্তত অনলাইনেও প্রতিবাদ জানাক। এদেশের মানুষ এমনিতেই এখন ভয়ে থাকে। লিখতে, বলতে এমনকি ফেসবুকে একটা লাইক, শেয়ার বা কমেন্ট করতেও দশবার চিন্তা করে। আছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের রক্ত চক্ষু, আছে নানান জানা-অজানা আশঙ্কা। গত কয়েক বছরে এ দেশের মানুষকেতো কেবল আইনের মাধ্যমে ধরা হয়নি। তাদের গুম করা হয়েছে, তুলে নিয়ে আটকে রাখা হয়েছে, ঘটানো হয়েছে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড। মুক্তিযুদ্ধের মতো জনযুদ্ধকে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে জাতিকে বিভাজিত করতে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতা, মানচিত্র, পতাকা আর নিজস্ব পরিচয়টি কেনা হয়েছিল লক্ষ মানুষের রক্ত-ঘামে। সবকিছুই আমরা দেখছি, শুনছি। কিন্তু বলছি না। কিন্তু সুবর্ণজয়ন্তীর দিনেও এটা দেখতে হলো।