মোদির সফরের বিরোধিতা অব্যাহত রাখার ঘোষণা হেফাজতের

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে হেফাজতে ইসলাম। মোদির আমন্ত্রণপত্র বাতিলের জন্য তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। অন্যথায় রাজপথে সংঘাতমূলক কর্মসূচি না থাকলেও সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। সোমবার (২২ মার্চ) হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জুনায়েদ আল হাবিব সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
জুনায়েদ আল হাবিব বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। উম্মতে মুসলিমার ইমান-আকিদার সংরক্ষণ এবং নাস্তিক মুরতাদ ও ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠীর ঘৃণ্য অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামের মর্যাদা সমুন্নত রাখা এই সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। একইসঙ্গে দেশবিরোধী যেকোনো চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো হেফাজতের নৈতিক কর্তব্য।’ তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত হেফাজতে ইসলাম-বাংলাদেশ ইমান-আকিদার সংরক্ষণে আপসহীন ও সাহসী ভূমিকা পালন করে আসছে। এ কারণে প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে ছদ্মবেশী গোষ্ঠী ইসলামকে নিজেদের অপতৎপরতা মোকাবিলায় শক্ত প্রতিপক্ষ ভেবে প্রকাশ্যে ও ছদ্মবেশে বারবার নিজেদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। তাদের চক্রান্ত আমাদেরকে নিজেদের কাজের ব্যাপারে আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছে। হেফাজতে ইসলামের প্রতি দেশবাসীর ভালবাসা এবং আস্থাও বৃদ্ধি পেয়েছে।’
জুনায়েদ আল হাবিব বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে সরকার বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। এসব প্রোগ্রামে অতিথি হিসেবে বেশ কয়কজন রাষ্ট্রনেতা অংশগ্রহণ করছেন। অতিথিদের তালিকায় রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিশ্বের কাছে যার আরেক পরিচয় ‘গুজরাটের কসাই’। এ ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, এমন কাউকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা উচিত হবে না বা যার আগমন এদেশের মানুষকে আহত করবে।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একজন মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস ভুলে যাওয়ার মতো নয়। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং সেখানে অন্যায়ভাবে মন্দির নির্মাণের সিদ্ধান্তে আমাদের হৃদয়ে রক্তপাত হয়। এছাড়াও কাশ্মীরে মুসলিম নির্যাতন এবং নাগরিকত্ব আইনসহ প্রতিটি মুসলিমবিরোধী সিদ্ধান্তের মূলহোতা এই নরেন্দ্র মোদি। বছর খানেক আগে তার অনুসারীদের হাতে দিল্লিতে মুসলমানদের রক্তের বন্যা বয়ে গেছে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মসজিদের মিনার ভেঙে সেখানে হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া পতাকা টানানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের নামে আসামে লাখ লাখ মুসলমানকে বাংলাদেশি অভিহিত করে অনেকটা বন্দী করে রাখা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার মুসলমানদেরও অনিরাপদ অবস্থায় ঠেলে দেয়া হচ্ছে। একাধিকবার নরেন্দ্র মোদি তার ভাষণে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদেরকে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী অভিহিত করে তাদেরকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে না দিলে ভারতের মানুষেরা চাকরি পাচ্ছে না বলে উস্কানি দিয়েছেন। আজ ভারতের মুসলমানদের মিথ্যা ও ঠুনকো অজুহাতে প্রকাশ্য রাজপথে পিটিয়ে, কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে মোদি সরকারের পরোক্ষ ইশারায়।’ হেফাজতের এই নেতা বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ও বঞ্চনার তালিকাও বেশ দীর্ঘ। গঙ্গার পানিচুক্তি যে প্রত্যাশার পরিবেশ তৈরি করেছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি। তিস্তা নদীর পানি বন্টনচুক্তি পেছাতে পেছাতে এখন তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইনে বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সীমান্তে প্রতিনিয়ত নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা করে যাচ্ছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। পৃথিবীর সবচেয়ে শত্রুতাপূর্ণ ইসরাইল-ফিলিস্তিন সীমান্তে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী কিংবা পাক-ইন্ডিয়া বর্ডারেও এমন নির্বিচারে হত্যার ঘটনা ঘটে না। আমরা নিদারুণ ক্ষোভের সঙ্গেই দেখছি যে, বর্ডার কিলিংয়ের পক্ষে তারা নানারকম খোঁড়া যুক্তিও দেয়। দেশের সচেতন ও দেশপ্রেমী নাগরিক হিসেবে আমরা ভারতের এমন অসভ্য আচরণের নিন্দা জানিয়ে চুপ থাকতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনে নরেন্দ্র মোদির মতো একজন ব্যক্তি আসুক এটা আমরা চাই না।আমরা দেশের অধিকাংশ মানুষের সেন্টিমেন্টের প্রতি সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নিকট নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণ বাতিলের আহ্বান জানাই। আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, মুসলমান হিসেবে ঈমানি দায়িত্ব ও দেশ প্রেমের দায়বোধ থেকেই নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরুদ্ধে আমাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে।’
জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, ‘গত ১৭ মার্চ বুধবার সকালে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের সংখ্যালঘুদের ওপর জঘন্য আক্রমণ হয়েছে। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে বসতভিটা। আমরা তাৎক্ষণিক এর নিন্দা জানিয়েছি এবং আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে পুনরায় নিন্দা জানিয়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই ঘটনার যাচাই-বাছাই ছাড়াই এক শ্রেণীর মিডিয়া তাৎক্ষণিক প্রচার শুরু করে দেয় যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে জনৈক ঝুমন দাসের ফেসবুকের কটূক্তির প্রতিবাদে এই হামলা হয়েছে। পাশাপাশি কোনো ধরনের নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই এই ঘটনার দায় হেফাজতে ইসলামের ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়।’ ‘অথচ দুদিনের মাথায় জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এই বর্বরোচিত ঘটনার সঙ্গে হেফাজতে ইসলাম বা মাওলানা মামুনুল হকের দূরতম সম্পৃক্ততাও নেই’ বলে যোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ইসলাম শান্তি, মানবতা ও সম্প্রীতির ধর্ম। অন্যায়ভাবে কারো ওপর আঘাত করার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। ইসলাম সংখ্যালঘুদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। বিপুল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এদেশে যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিয়ে সংখ্যালঘুরা বসবাস করছেন।’
হেফাজত নেতা বলেন, ‘অতীতেও দেশের কোথাও সংখ্যালঘু নির্যাতনের সাথে সাথে আলেম-উলামা কিংবা ইসলামী সংগঠনের ন্যূনতম সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অথচ যখনই কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপসনালয় ও বাড়িঘরে হামলা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তাৎক্ষণিক দেশি-বিদেশি চিহ্নিত ইসলামবিদ্বেষী মহল ইসলামী সংগঠন এবং ওলামা কেরামের ওপর দায় চাপিয়ে বিভ্রান্তিকর ও প্রোপাগান্ডা চালায়। পরবর্তীতে স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার কিংবা রাজনৈতিক কোন্দলের কারণে এমন ঘটনা সংঘটিত হবার প্রমাণ মিললেও গণমাধ্যমে তার অসত্য সংবাদের জন্য ভুল স্বীকার করে না। এতে সামাজিকভাবে ওলামায়ে কেরাম ক্ষতিগ্রস্ত হযন। আর সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে ইসলাম ও দেশবিরোধী গোষ্ঠী।’ জুনায়েদ আল হাবিব বলেন, ‘সরকারের কাছে আবেদন করছি, শাল্লার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন। একইসঙ্গে আমরা সুনামগঞ্জের উলামায়ে কেরামসহ সবাইকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই।’ সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মহানগরের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছি, আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করব। রাজপথে আমাদের কোনো সংঘাতমূলক কর্মসূচি থাকবে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা যেকোনো কর্মসূচি বিবেচনায় নেব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করব, এই মুহূর্তে কোনো কর্মসূচি ঘোষণা না করলেও পরিস্থিতির আলোকে হেফাজতে ইসলাম কেন্দ্রীয় কমিটির পরামর্শক্রমে যেকোনো কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারি।’