মিয়ানমার জান্তার লাগাম টানতে অর্থনৈতিক চাপই কি যথেষ্ট?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে বুক কাঁপেনি মিয়ানমার সেনাদের। গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে তারা ২০০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীকে হত্যা করা হয়েছে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ করার সময় দূর থেকে মাথায় গুলি করে। বাকিদের প্রাণ গেছে অভ্যুত্থানবিরোধী সন্দেহে সেনাদের বেপরোয়া গুলিতে। এরপরও হাল ছাড়েননি মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীরা। এ সপ্তাহে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ আর বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক আইন জারির পরেও বিক্ষোভ হয়েছে ইয়াঙ্গুন ও মান্দালয় শহরে। তবে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে কার্যত গোটা মিয়ানমারেই। আগে যেসব ফ্রিজ মিয়ানমার বিয়ারের ক্যান দিয়ে ভরা থাকত, এখন সেগুলো খালি। এর একমাত্র কারণ, পানীয়টির প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের আংশিক মালিকানা দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে। জনপ্রিয় একটি সিগারেট ব্র্যান্ড, একটি বৃহৎ মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে উঠেছে বয়কটের সুর। এছাড়া সেনাশাসনের প্রতিবাদে ধর্মঘটে গেছেন বহু সরকারি কর্মকর্তা। এগুলোর মাধ্যমে জান্তা সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, মিয়ানমারের সেনাশাসকরা অর্থসংকটে ভুগছেন। অভ্যুত্থানের কয়েকদিন পরেই দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে এক বিলিয়ন ডলার ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে মার্কিন প্রশাসন মিয়ানমার সেনাদের সেই প্রচেষ্টা আটকে দেয়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশটির জান্তা সরকার ২০০ বিলিয়ন কিয়াট (মিয়ানমারের মুদ্রা) পাঁচ বছর মেয়াদী বন্ড বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা পায় মাত্র ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিয়াট, তা-ও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক চড়া সুদে। আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে, মিয়ানমারের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আটকে যাওয়া এক বিলিয়ন ডলারও রয়েছে। এই অর্থ দিয়ে খুব বেশি হলে পাঁচ মাসের আমদানি-ব্যয় মেটানো যাবে। গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলোর মধ্যে মিয়ানমার জ্বালানি ও রান্নায় ব্যবহৃত সব তেলই বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। এসব পণ্যের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে, অন্যদিকে কিয়াটের মান কমছে। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগেও পড়েছে বিক্ষোভ-সহিংসতার প্রভাব। সম্প্রতি মিয়ানমারে একাধিক চীনা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অবশ্যই কিছু বিনিয়োগকারী পিছু হটবেন বলে ধরা যায়। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের জন্য বৈদেশিক অর্থই একমাত্র দুর্বলতা নয়। সেনা অভ্যুত্থানের আগেই বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল, এ বছর দেশটিতে জিডিপির ৮ দশমিক ১ শতাংশ বাজেট ঘাটতি দেখা যেতে পারে। এরপর গণবিক্ষোভে তাদের অর্থনীতি একপ্রকার গতিশূন্যই হয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা তাতমাদাও নিয়ন্ত্রিত প্রধান সংস্থা মায়ানমা ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেড (এমইএইচএল) দেশটির বৃহত্তম করদাতা, তাদেরই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মিয়াওয়াদি ব্যাংক এক্ষেত্রে পঞ্চম। বর্তমানে তারা উভয়ই জনতার বয়কট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু। ফলে দেশটির ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ঘাটতি পূরণ ধীরে ধীরে আরও কঠিন হয়ে উঠছে। এসব পরিসংখ্যান যথেষ্ট উদ্বেগজনক, সাধারণ সরকার হলে এর জন্য অবশ্যই কর্মপন্থা পরিবর্তন করত। তবে জান্তা সরকার তেমন কোনও সাধারণ সরকার নয়। তারা জানে, প্রকৃতিক সম্পদ বিক্রি করে ন্যূনতম বৈদেশিক মুদ্রা আয় চলতেই থাকবে। মিয়ানমার এমনিতেই কর সংগ্রহের চেয়ে তেল-গ্যাস বিক্রি করেই বেশি অর্থ আয় করে। তাতমাদাও দীর্ঘদিন থেকেই অবৈধ চাঁদাবাজি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে রত্ন ও কাঠ পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়, তারা মেথামফেটামাইনের মতো মাদক ব্যবসায় সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, বিশেষ করে নিরপেক্ষ সীমান্ত এলাকাগুলোতে। এমনকি, দেশটির সেনাবাহিনী নিজেদের সদস্যদের কাছ থেকেই জোরপূর্বক অর্থ আদায় করে।
২০১৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের জেরাল্ড ম্যাকার্থিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিয়ানমার সেনারা জানিয়েছিলেন, বেতনের ১০ থেকে ২৫ শতাংশ এমইএইচএলের শেয়ারে ব্যয় করার নির্দেশ রয়েছে তাদের ওপর। বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে জান্তা সরকার এসব পদ্ধতিতে অর্থসংগ্রহ দ্বিগুণ করার চেষ্টা করতে পারে।তাছাড়া, দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজানো নিয়েও খুব একটা মাথাব্যথা নেই তাতমাদাওয়ের। যারা নিজেদের জনগণের ওপর গুলি চালাতে পারে, তারা জনসেবা কার্যক্রম সীমিত হয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তায় পড়বে, এমনটা ভাবা বাহুল্য। মুদ্রাস্ফীতির কী অবস্থা হবে তা হিসাব না করে জান্তা সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অর্থ ছাপানোরও নির্দেশ দিতে পারে। জনতার বিক্ষোভের কারণে একদিক থেকে লাভও হচ্ছে মিয়ানমার সেনাদের। এক কাস্টমস কর্মকর্তা ফ্রন্টিয়ার নামে একটি স্থানীয় সাময়িকীকে জানিয়েছেন, বিক্ষোভের মধ্যে দেশটিতে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের কন্টেইনার ট্রাক চলাচল করছে, আর সেটির মালিক সেনানিয়ন্ত্রিত এমইএইচএল। এসব ট্রাক প্রতি ট্রিপের জন্য ৮০ হাজার কিয়াট নিচ্ছে, যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আটগুণ বেশি। অবশ্য কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলোতে মনে হয়, জান্তা সরকারের দুশ্চিন্তাও কম নয়। তারা আমদানি করা তেলের ওপর নির্ভরতা কমানোর উপায় খুঁজতে সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করেছে। কর্মী ধর্মঘটের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যাংকের সংখ্যা বাড়তে থাকাও সেনাশাসকদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। এধরনের কর্মীদের কাজে ফেরাতে জান্তা সরকার কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে, অবশ্য তাতে এখন পর্যন্ত খুব একটা লাভ হয়নি। সম্প্রতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০০ কর্মকর্তাকে অনুপস্থিতির কারণে বরখাস্ত করা হয়েছে। এত কিছুর পরেও মিয়ানমার সেনারা পথ বদলাবেন কিনা তা অনিশ্চিত, তবে এতে যে দেশটির অর্থনীতির বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে ক্ষতি যা হওয়ার হবে সাধারণ নাগরিকদেরই, জান্তা ও এর মিত্রদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম। এটি আরও একটা বিষয় মনে করিয়ে দেবে, তা হচ্ছে- এর আগেও একাধিকবার মিয়ানমারের অর্থনীতি ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে গেছেন দেশটির সেনাশাসকরা।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট