অস্থিরতা কমছে না চালবাজারে

0

সুন্দর সাহা ॥ ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে চালের বাজার। ইতোমধ্যে ৩০-৩২ টাকা দরের চাল রেকর্ড ভেঙে ৫০ টাকায় উঠেছে। সরু চাল উঠেছে ৬৬ টাকা পর্যন্ত। এমন অস্বাভাবিক দামে স্বল্প আয়ের খেটে খাওয়া মানুষদের নাভিশ্বাস উঠেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন শর্তে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দিলেও তা কোনো কাজে আসছে না। সিন্ডিকেটধারীদের কাছে যেন সবাই অসহায়। কোনো কিছুতেই ধরাশায়ী করা যাচ্ছে না তাদের। ভারত থেকে চাল আমদানির পর বেনাপোল ও ভোমরাসহ বিভিন্ন স্থলবন্দর থেকেই সব চাল চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের হোতাদের কাছে। এমনিতেই করোনাকালে মানুষের আয় কমেছে। এ অবস্থায় চালসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের চড়া দামে অসহায় হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
যশোরসহ সারা দেশে বেড়েই চলেছে চালের দাম। মোটা-মাঝারি-চিকন সব ধরনের চালের দামই বেড়েছে। কেজিতে ২-৩ টাকা করে বাড়তে বাড়তে এখন যশোরে মোটা চাল স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৪ টাকায়। বাজারে মাঝারি মানের চিকন চালের কেজি এখন ৬০ টাকা। নাজিরশাইল ও মিনিকেটের দাম ৬৬ টাকার বেশি। গত বছরের এই সময়ে দাম ছিল ৩৫-৩৮ টাকা। সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর হিসাবমতে গত একবছরে মোটা চালের দাম বৃদ্ধির হার ৩৭ শতাংশ। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত সপ্তাহে ৬৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া চাল এ সপ্তাহে ৬৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে স্বর্ণা নামের মোটা ও মাঝারি মানের চালের দামও বেড়েছে একই হারে। ব্যবসায়ীরা আগের সুরেই বলছেন, সরবরাহ স্বাভাবিক হলে দাম কমবে। চালের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে সরকারি অনুমতিতে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি করা হচ্ছে। কমানো হয়েছে চালের আমদানি শুল্কও। অদৃশ্য কারণে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিভিন্ন শর্তে বেসরকারি পর্যায়ে ৩৭৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ ৯৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক চাল দেশে ঢুকেছে। বাকি চাল আমদানির অপেক্ষায় পাইপ লাইনে আছে। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের ১১৩ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আমদানি করা হয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার টনেরও বেশি। আবার বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে আমদানি করা সব চাল ১৫ মার্চের মধ্যে বাজারে আনার নির্দেশ দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। খাদ্য অধিদফতরকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, আমদানির জন্য অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যারা ইতোমধ্যেই এলসি খুলেছেন কিন্তু বাজারজাত করতে পারেননি, তাদের বরাদ্দ দেয়া সব চাল আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে আনতে হবে। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (বৈদেশিক সংগ্রহ) মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান লোকসমাজকে বলেন, ‘চাল আমদানির অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে এলসি খোলার কতদিনের মধ্যে চাল বাজারজাত করতে হবে তা বলে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন পরিমাণের জন্য এই সময়ও ভিন্ন। এখন চাল বাজারজাতকরণের শেষ সময় সবার জন্যই ১৫ মার্চ করে দেয়া হলো।’ এর আগে খাদ্যশস্যের বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রবণতা রোধ, নি¤œআয়ের জনগোষ্ঠীকে সহায়তা এবং বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে বেসরকারি পর্যায়ে চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে সরকার। শুল্ক কমিয়ে এবং আমদানি বাড়িয়ে বিপুল পরিমাণ চাল দেশে আসলেও কমছে না বাজার দর। এসব উদ্যোগের কোনো সুফল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের। বাজারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কোনো মটিরিং না থাকায় সিন্ডিকেটের হোতারা হয়ে পড়েছেন বেপরোয়া।
চাল আমদানির শর্তে বলা হয়েছে, এলসি খোলা সংক্রান্ত তথ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়কে তাৎণিকভাবে ই-মেইলে জানাতে হবে। বরাদ্দপ্রাপ্ত আমদানিকারককে এলসি খোলার ১০ দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং ২০ দিনের মধ্যে পুরো চাল বাজারজাত করতে হবে। এছাড়া বরাদ্দে অতিরিক্ত আইপি (ইম্পোর্ট পারমিট) জারি বা ইস্যু করা যাবে না। আমদানি করা চাল স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠানের নামে প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করা যাবে না। প্লাস্টিকের বস্তায় আমদানি করা চাল বিক্রি করতে হবে। কিন্তু এসব নিয়ম মানছেন না বেসরকারি চাল আমদানিকারকরা। বরং চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। এ কারণেই ভারত থেকে আমদানির পর সব চাল চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের হোতাদের কাছে। এতোদিন যারা বিভিন্ন হাট বাজারে ফড়িয়া, পাইকার ও আড়ৎদারি করতেন, তারা জোট বাধেঁন চাল আমাদানির অনুমতি পাওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের সাথে।
অভিযোগ উঠেছে, বেনাপোল ও ভোমরাসহ বিভিন্ন স্থলবন্দরে চাল আসার পর তার সিংহভাগ চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের হোতাদের কাছে। চাল গুদামজাত করে সিন্ডিকিটের হোতারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ চক্রের কারণে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়েছে। দেশে ধারাবাহিকভাবে যেমন চাল আমদানি হচ্ছে। তেমন ভাবে দাম তো কমছেই না। বরং চালের দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই।
এদিকে মিলাররা জানিয়েছেন, এ বছর আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় যে দাবি করেছে তা সত্য নয়। তারা বলেছেন, এ বছর বন্যায় ভেসে আসা পলির কারণে ধানের গাছ উর্বর হলেও উৎপাদন কম হয়েছে। প্রতি একরে ৪০ মণ হওয়ার কথা থাকলেও ২৫-২৬ মণের বেশি উৎপাদন হয়নি। এ কারণে দেশের বিভিন্ন বাজারে প্রতিমণ ধান বিক্রি হয়েছে ১২/১৩শ টাকায়। এ বিষয়ে সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, চালকল মালিকরা (মিলার) নানা কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছে। উৎপাদনের যে ঘাটতি হয়েছে তা মেটাতে সরকারিভাবে ৫ লাখ টন চাল আমদানি করছে। সরকারি গুদামেও চাল কমে গেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চাল ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী লোকসমাজকে বলেন, ধানের মূল্য বৃদ্ধির কারণেই মূলত চালের দাম বাড়ছে। এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন, মিলাররা নয়। তিনি সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, ধান-চালের ব্যবসা অনেক বড়। সিন্ডিকেট করা সম্ভব নয়। এ ব্যবসা যদি চার-পাঁচজন করতো তা হলে সিন্ডিকেট করা যেতো। ধানের দাম বৃদ্ধির কারণেই এবারের আমন মৌসুমে চাল সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহবুবুর রহমান খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি লোকসমাজকে বলেন, ‘নি¤œআয়ের জনগোষ্ঠীকে সহায়তা প্রদান এবং বাজারদর স্থিতিশীল রাখতেই বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। যেটা কৃষিবিভাগের মনিটরিং করা উচিত ছিল। কারণ, এ বছর ধানের উৎপাদন অন্তত ৩০ লাখ মেট্রিক টন কম হয়েছে। যে কারণে বাজারে চালের দামের এই উর্দ্ধগতি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাজার দরের বেপরোয়া উর্দ্ধগতির কারণে এবারের আমন মৌসুমে সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হতে চলেছে। কারণ, যে চালের সরকারি সংগ্রহ মূল্য ৩৭ টাকা, সেই চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা দরে। দুই মাস পর বোরো ধান উঠলে বাজার আবার ফের স্থিতিশীল হবে।’