ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন : ‘আইন বাতিলের প্রশ্নই ওঠে না, তবে নজর রাখছে সরকার’

0

শফিকুল ইসলাম॥ সারাদেশে বিভিন্ন মহল থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলসহ সংশোধনের দাবি উঠলেও এখন পর্যন্ত সরকারের আনুষ্ঠানিক কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ আইন বাতিলের দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে অনেক সংগঠন। এরপরও সরকার নীরব। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কয়েকজন মন্ত্রী জানিয়েছেন, আইন বাতিলের প্রশ্নই ওঠে না। তবে এর যথাযথ প্রয়োগে ব্যত্যয় ঘটছে কিনা সরকার সেদিকে নজর রাখছে। সংশোধন করা হবে কি না তা জানতে আরও সময় লাগবে। ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাসহ বিতর্কিত সব ধারা এবং প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাসহ বিতর্কিত ধারা বাদ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ‘সম্পাদক পরিষদ’ নেতারা। তখন তাদের দাবি ছিল, তাড়াহুড়া না করে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রস্তাবিত আইনটি চূড়ান্ত করা হোক।
উল্লেখ্য, আইনটি প্রণয়নের পর থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছিল দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ গণমাধ্যমের সম্পাদকরা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেতারকৃত মুশতাক আহমেদ জেলখানায় মারা যাওয়ার পর থেকে এ দাবি আবার জোরদার হচ্ছে। মুশতাকের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে কমিটিও করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পুরোপুরি বাতিলের সিদ্ধান্ত জানাতে সরকারকে আগামী রবিবার (৭ মার্চ) পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। শুক্রবার (৫ মার্চ) রাজধানীর শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মুশতাক হত্যার বিচার, ছাত্র-শ্রমিক, রাজবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের’ দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে এই আলটিমেটাম দেওয়া হয়। আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও (সিপিবি)। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম জানিয়েছেন, ‘লেখক-কার্টুনিস্ট, সাংবাদিক ও ছাত্রদের এ আইনে গ্রেফতার করে জেলে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। সরকার সুপরিকল্পিতভাবে বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাতের অন্ধকারে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনসহ এ আইনের ‘অপব্যবহার’ বন্ধের দাবি জানিয়েছে ইসলামি যুব আন্দোলন। রাজধানীতে মানববন্ধন ও সমাবেশও করেছে সংগঠনটি। সংগঠনটির সেক্রেটারি জেনারেল আতিকুর রহমান জানিয়েছেন, এই আইন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সাংবাদিক ও সমাজের সচেতন নাগরিকদের কণ্ঠরোধ করে দিচ্ছে। এভাবে জনগণের অধিকার ক্ষুন্ন করা যাবে না।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আইনটি যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনও ব্যত্যয় ঘটছে কিনা সরকার সেদিকে কড়া নজর রাখছে। প্রযুক্তির এই যুগে জনস্বার্থেই এ আইন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শুক্রবার নিজের নির্বাচনি এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনও সংশোধন বা পরিবর্তন আনা হবে কিনা তা ‘কিছুদিনের মধ্যে’ দেখা যাবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এর আগে ১ মার্চ বিবিসি বাংলাকে আইনমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এই আইনে কোনও অভিযোগ এলে তদন্তের আগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না, বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া যাবে না- এমন একটি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বলেছি, সরাসরি মামলা নেওয়া হবে না। অভিযোগ এলে পুলিশ প্রথমে তদন্ত করে দেখবে।’ এ প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, ‘কোনও আইনে যদি কেউ গ্রেফতার হয় এবং তিনি যদি কারাগারে স্বাভাবিকভাবে মারা যান, তবে সেই আইন বাতিল করতে হলে সব আইনই বাতিল করার কথা আসে।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলে নাগরিক সমাজের দাবির প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘তাঁরা কয়েকজন এটা বলেছেন। যে কয়েকজন সবসময় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশে সুশীল সমাজের আরও লাখ লাখ নাগরিক আছেন।’
২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাসহ বিতর্কিত সব ধারা এবং প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাসহ বিতর্কিত ধারা বাদ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল ‘সম্পাদক পরিষদ’। তাদের দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি প্রসঙ্গে অপরাধের ধরন ও শাস্তির যে বিধান রাখা হয়েছে, তা গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনা এবং বাকস্বাধীনতায় আঘাত করবে। উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত আইনে সরকারি সংস্থার গোপনীয় তথ্য কেউ কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ করলে তা কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি বলে সাব্যস্ত হবে। এর জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একাধিকবার কেউ এ অপরাধ করলে তার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। পরিষদ বলছে, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর মতো বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়াই সন্নিবেশিত ছিল। এগুলোর ক্রমাগত অপপ্রয়োগ হতে থাকায় সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আইনটি বাতিলের জোরালো দাবি ওঠে। সম্পাদক পরিষদ বলছে, আইনমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইসিটি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্তি হবে। কিন্তু ৫৭ ধারার বিষয়বস্তুগুলো প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারায় সুকৌশলে রেখে দেওয়া হয়েছে। পরিষদ মনে করে, প্রস্তাবিত এ আইন আরও কঠোর। এটি শুধু মুক্ত সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিসরকেই সংকুচিত করবে।