ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা জরুরি

0

দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশের পাশাপাশি পেশাদার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আইনটি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ২০১৮ সালে আইনটি যখন সরকার প্রণয়ন করে, তখনই দেশের সাংবাদিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার সংস্থাসহ সচেতন মহল এর তীব্র বিরোধিতা ও প্রতিবাদ করেছিল। আইনটির কয়েকটি ধারা সংশোধনের জন্য বারবার অনুরোধ করলেও সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। ফলে এই আইনটি এখন স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং বাকস্বাধীনতারে ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেউ সরকার কিংবা ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ডের যৌক্তিক সমালোচনা করলেও তার উপর এ আইনের খড়গ নেমে আসছে। এর নজির ইতোমধ্যে স্থাপিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যাভিত্তিক সংস্থা আর্টিক্যাল ১৯-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে এই আইনের অধীনে মোট ১৯৮টি মামলা করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৪৭৫ জনকে। এর মধ্যে ৪১টি মামলার আসামি করা হয়েছে ৭৫ জন পেশাদার সাংবাদিককে। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ৬৩টি। দেখা যাচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে, এই আইনের অপব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীসহ সচেতন মহলের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে অনেককে জেলে যেতে হয়েছে, এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবার এই আইনে কারাবন্দী থাকা অবস্থায় কাশিমপুর কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন লেখক মুশতাক আহমেদ। এছাড়া কারাবন্দী কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
গত বছরের মে মাসে লেখক মুশতাক আহমেদ, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে র‌্যাব ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে। এ মামলায় মুশতাক আহমেদ ও আহমেদ কবির কিশোরসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। বাকি দুইজনের জামিন হলেও মুশতাক ও কিশোরের জামিন হয়নি। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, মুশতাকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সে অভিযোগ ধোপে টেকে না, তার কোনো গুরুত্বই নেই। বারবার তার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এই আইনটি হয়রানিমূলক, কালো আইন, এর পরিবর্তন হওয়া উচিৎ। এটা পরিস্কার, সরকার গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা মুখে মুখে বললেও গঠনমূলক যেকোনো স্বাধীনমত প্রকাশ সহ্য করতে পারছে না। এই মত প্রকাশ করতে গিয়ে কেউ কেউ হয়তো গুজব ও ভিত্তিহীন তথ্য উপস্থাপন করছে, তবে তারা কারা এবং তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড কি তা বিবেচনায় নেয়া উচিৎ। যদি একজন দায়িত্বশীল লেখক, পেশাদার সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সচেতন মানুষ মতামত প্রকাশ করে তবে সেটা তার অবস্থানের নিরিখে বিবেচনা করা উচিৎ। এতে সরকার নাখোশ হওয়ার চেয়ে বরং তার মতামত শ্রদ্ধার সাথে নিয়ে সংশোধন বা ব্যাখ্যা দিতে পারে। তা না করে কিংবা যুক্তি দিয়ে খন্ডন করতে না পেরে রাগ-ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে বিতর্কিত আইনের আশ্রয় নিয়ে তাকে গ্রেফতার এবং জেল-হাজতে পাঠিয়ে দেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারকে সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হয়, পরমতকে শ্রদ্ধার সাথে নিতে হয়। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার মতের সাথে আমি একমত নাও হতে পারি, তবে তোমার মত প্রতিষ্ঠায় আমি জীবন দিতে প্রস্তুত।’ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকারের বৈশিষ্ট এমনই হওয়া উচিৎ। আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে এর উল্টো চিত্র। সরকার গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কথা বলছে ঠিকই, তবে গণতন্ত্র মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, তা মানা হচ্ছে না। নির্বতনমূলক আইন করে তা দমন করা হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছে। চীন, জাপানের মতো অর্থনৈতিক পরাশক্তির দেশগুলো ব্যাপক বিনিয়োগের পথে রয়েছে। ’২৪ সালে দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। এ প্রেক্ষিতে, উন্নত বিশ্বসহ বিনিয়োগে আগ্রহী দেশগুলো বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার পরিবেশ কতটা রয়েছে তা বিবেচনায় নেবে। এ সংক্রান্ত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনও পর্যালোচনা করবে। যদি মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব অবস্থায় থাকে, তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কথায় কথায় বা কারো মত পছন্দ না হলে হামলা-মামলা ও গ্রেফতার, সর্বোপরি সরকারের ভিন্নমত সহ্য না করার মানসিকতা কোনো ভাবেই কাম্য হতে পারে না। বর্তমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে নানাজন নানাভাবে মত প্রকাশ করছে। এখানে যেমন পারিবারিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত বিষয়াদি প্রকাশ করা হয়, তেমনি রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডের প্রশংসাও করা হয়। ডিজিটাল আইনের কারণে সাধারণ মানুষের অনেকেই সংযত। বিবেকবান এবং বুদ্ধিজীবী মহলের অনেকে গঠনমূলক সমালোচনা করেন। এই সমালোচনাকে সরকার ভালোভাবে না নিয়ে বা এর ব্যাখ্যা না দিয়ে সরাসরি নির্বনমূলক আইনের আশ্রয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দেয়া এবং গ্রেফতার করে জেলে নিয়ে যাচ্ছে। পেশাদার সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও একইভাবে আইনটির অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে। এভাবে আইন করে বাকরুদ্ধ করে দেয়া কোনো ভাবেই গণতান্ত্রিক আচরণ হতে পারে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ পর্যন্ত যত সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের প্রতিবেদন ও লেখার ব্যাখ্যা সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাছে চেয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হয়নি। বরং লেখা প্রকাশের সাথে সাথেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার করা হয়েছে। দিনের পর দিন হয়রানি ও জেলে বন্ধী করে রাখা হয়েছে। সেখানে তাদের সাথে সুআচরণ করা হয় না বললেই চলে। সরকারের প্রতিকূলে মতপ্রকাশের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একজন লেখক ও সাংবাদিককে গ্রেফতার করলেও তার অবস্থান অনুযায়ী যথাযথ সস্মান দেয় না। আমরা দেখছি, ফটোগ্রাফার কাজলসহ অন্য সাংবাদিক ও লেখককে কিভাবে দিনের পর দিন জেল খাটতে হয়েছে এবং হচ্ছে। সর্বশেষ লেখক মুশতাক আহমেদকে জেলেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। সরকারের এ ধরনের আচরণ বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতারই পরিচয় বহন করে। আমরা মনে করি, মতপ্রকাশের যৌক্তিকতাকে সরকারের গ্রহণ করা উচিৎ। এটাও মনে করি, সরকারের সমালোচনা করা যাবে না, এমন নিবর্তনমূলক আইন থাকা উচিৎ নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা সংবিধানের মৌলিক চেতনা, মতপ্রকাশ, বাকস্বাধীনতা, অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার পরিপন্থী। এসব ধারা বাতিল করে আন্তর্জাতিক আইন ও বিধানের সাথে সঙ্গতি রেখে আইনটি অবিলম্বে সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য আমরা সরকারের প্রতি আহবান জানাই।