লোকসমাজ ডেস্ক॥ তুরস্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতাসীন দলের এক নেতাকে রেক্টর নিয়োগ নিয়ে এক মাস আগে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল তা এখন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ৮ বছর আগে দেশজুড়ে হওয়া এক আন্দোলন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। চলমান বিক্ষোভকে তিনি এরইমধ্যে পূর্বের ওই বিক্ষোভের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তুরস্কের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি বোগাজিচি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন একে পার্টির এক নেতাকে রেক্টর নিয়োগ করছে দেশটির সরকার। এ নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন দমন করতে গিয়ে এরদোগান সরকার যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে তা এরইমধ্যে বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন এমন আশা আগে থেকেই ছিল। তার ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিকেই তুরস্ক সরকারের এমন দমন-পীড়ন বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সুসমপর্ক স্থাপনে তুরস্কের চেষ্টাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। একইসঙ্গে, তুরস্ক সামপ্রতিক সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সমপর্ক ঠিক করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। সেটিও হুমকির মুখে পড়েছে। জো বাইডেন নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর থেকেই এরদোগান তুরস্কের ভাবমূর্তি পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সংস্কারের দিকেও দৃষ্টি দিয়েছিলেন তিনি। আশা ছিল সামপ্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের দিকে যেভাবে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে সেটিতে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্মম নির্যাতন এবং আন্দোলন থামাতে সরকারের চেষ্টা তুরস্কের ভাবমূর্তিকে আরো প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। আন্দোলনকে ঘিরে দেশটির সরকার সমকামিতা বিদ্বেষ ছড়িয়েছে, শিক্ষার্থীদের কোনো কারণ ছাড়াই সন্ত্রাসী বলে দাবি করেছে। ফলে যে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তা অবনমিত হয়েছে। গত সপ্তাহের মঙ্গলবার এক টুইটে এরদোগানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমান সয়লু আন্দোলনকারীদের ‘এলজিবিটি সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যায়িত করেন। তুরস্ক সরকারের এই এলজিবিটিকিউ বিদ্বেষের নিন্দা জানিয়েছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট। একইসঙ্গে আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশটি। সমকামীদের নিয়ে এমন ঘৃণা ছড়ানোর নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘও। গ্রেপ্তার হওয়া আন্দোলনকারীদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে সংস্থা দুটি। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে আসা নিন্দা প্রত্যাখ্যান করেছে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের দাবি, এটি তুরস্কের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। যোগ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোগানও। তিনি বলেছেন, এলজিবিটিকিউ বলে কিছু হয়ই না। গত ৪ঠা জানুয়ারি শুরু হওয়া আন্দোলন থেকে এরইমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শত শত আন্দোলনকারীকে। শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাস ছাড়িয়ে এলজিবিটি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে আঙ্কারা, ইজমির ও বুরসাসহ বড় বড় শহরগুলোতে। স্থানীয় পর্যায় থেকে সাধারণ মানুষরা এই আন্দোলনে সমর্থন প্রদান করছেন। প্রতি বিকালেই দেখা যাচ্ছে বারান্দা থেকে থালা বাসনের শব্দ করে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারা। ১৮ বছর ধরে তুরস্কের ক্ষমতায় থাকা এরদোগানকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন ২০১৩ সালের গেজি আন্দোলনের কথা।
এদিকে, চলমান সংকট নিয়ে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে একটি ভোট (অপিনিয়ন পোল) আয়োজন করা হয়। এতে ৬৯ শতাংশ তুর্কি নাগরিক জানিয়েছেন, তারা রাজনৈতিক সংযোগ রয়েছে এমন রেক্টরের নিয়োগের বিরুদ্ধে। এমনকি মুসলিমদের ইস্যু নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার গ্রুপ মজলুম-দারও সরকারের এমন আচরণের নিন্দা জানিয়েছে। এ নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে তারা। এতে বলা হয়েছে, জনগণের ক্ষমতা ব্যবহার করে স্বেচ্ছাচারিতা চালানো মানবাধিকার লঙ্ঘন। সব মিলিয়ে এ আন্দোলন এরদোগানের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ আবার মনে করছেন, ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে এটি তার জন্য বড় সুযোগও হতে পারে। ইস্তাম্বুলের সাবানচি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বার্ক এসেন বলেন, এই আন্দোলন এরদোগানের জন্য যথেষ্ট বিব্রতকর। তিনি কোনোভাবেই আশা করেননি তার নিয়োগ দেয়া রেক্টরকে নিয়ে মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।এর আগেও এরদোগান ইচ্ছে মতো নিজ দলের অনেক রেক্টর নিয়োগ দিয়েছেন। তবে সেসব ক্ষেত্রে দেখা গেছে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা কোনো না কোনো ভাবে ফ্যাকাল্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সবারই আশঙ্কা ছিল, হয়তো একদিন বাইরে থেকেই রেক্টর নিয়োগ দেয়া শুরু করবেন এরদোগান। অবশেষে সে আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে।