টিকা নিয়ে কুসংস্কার-অনীহা দূরীকরণে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥সকলের করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করতে ‘নো ভ্যাক্সিন, নো সার্ভিস’ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং ভেজালমুক্ত টিকার সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য টিকা প্রদান বিনামূল্যে করতে হবে। টিকা নিয়ে কিছু সমস্যা থাকলেও টিকা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার মানে নিজে অনিরাপদ থাকা এবং সমাজ তথা জাতিকেও নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া। সরকারি দলের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও টিকাদান কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে জাতীয় উদ্যোগের আবহ তৈরি করতে হবে। রাতে (০৭ ফেব্রুয়ারি) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘বাংলাদেশে কোভিড-১৯ টিকার বাস্তবতা এবং অতিকথন’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে আলোচকরা এসব মতামত ব্যক্ত করেন।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের সদস্য, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লুবনা ইয়াসমিনের সঞ্চালনায় এতে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ডা. শারমিন ইয়াসমিন, সুইডেনের গোথেনবার্গ ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর খান সোহেল এবং যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডা. খন্দকার মেহেদী। বক্তব্যের শুরুতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আলোচনার আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ডা. শারমিন বলেন, শুধু টিকা-ই নয় যেকোন নতুন কিছু নিয়েই অতিকথন বা গুজব ছড়ানো হয়। টিকার আগে করোনাভাইরাস নিয়েও এগুলো হয়েছে। আর এসবের অনেক কিছুই করা হয় উন্নত দেশগুলো থেকে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির কারণে সহজেই সেগুলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। করোনার টিকা কিভাবে এতো দ্রুত পাওয়া গেলো, এর কার্যকারিতা শতভাগ কিনা, টিকা নেয়ার অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা, বয়োজ্যেষ্ঠদের টিকা দিয়ে লাভ আছে-কি-নেই ইত্যাদি অনেক বিষয় নিয়েই অতিকথন বা গুজব ছড়ানো হয়েছে। এসব নিয়ে সকল স্তরের জনগণকে সচেতন করতে হবে। টিকা দেয়া নিয়ে কিছু সমস্যা থাকলেও টিকা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার মানে নিজে অনিরাপদ থাকা এবং সমাজ তথা জাতিকেও নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি মধ্যে ফেলে দেয়া।
এসব সমস্যা সমাধানে ডা. জাহাঙ্গীর মানুষকে বাস্তবতা উপলব্ধি করার জন্য সচেতন করতে জোর দিয়ে বলেন, নীতিনির্ধারক এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডাররা কতোটা সত্যকে সামনে নিয়ে আসতে পারবেন তার উপর অনেককিছু নির্ভর করছে। সরকারকে এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। স্বচ্ছতার সাথে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সকল স্তরের জনপ্রতিনিধি সহ সকল মানুষকে আস্থার জায়গায় নিতে হবে। টিকা নিয়ে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা অন্য কোন সমস্যা হলে তা নিয়ে লুকোচুরি না করে মানুষকে এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে হবে, জানাতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল এবং বড় ভূমিকা পালন করতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউট থেকে টিকা আনার ব্যাপারে অনেকে অনেককিছু বললেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্যাভি সহ অনেক সংস্থার টিকার প্রধান উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানই সিরাম। সিরাম শুধু বাংলাদেশ-ই নয়, সারা বিশ্বে টিকা সরবরাহ করছে। সুতরাং সিরাম টিকার বিষয়ে নেতিবাচক হয় এমন কোন ঝুঁকি নেবে না। যুক্তরাজ্যে ইতিমধ্যে ১১ মিলিয়ন মানুষ টিকা নিয়েছে। সেখানেও শুরুতে টিকা নিয়ে নানা নেতিবাচক কথা বলা হলেও এখন মানুষ স্বেচ্ছায় টিকা নিতে আগ্রহী। দেশে মানুষকে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে সংসদ সদস্য, জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ব্যক্তিত্বরা প্রথমে টিকা নিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন। সেখানে সরকারি দলের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটা জাতীয় উদ্যোগের আবহ তৈরি করতে হবে। এটা সরকারের একা সফল হবার মতো কোনো বিষয় নয়। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অন্যদের নিয়ে করা আক্রমণাত্মক বক্তব্য থেকে বিরত থাকতে হবে। ইমাম, হুজুর, পুরোহিতসহ বিভিন্ন ধর্মগুরুরা নিজ নিজ সম্প্রদায়কে সচেতন করায় বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।
উন্নত দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালানো জরিপের ফল ব্যাখ্যা করে ডা. মেহেদী বলেন, শুধু বাংলাদেশ-ই নয়, বিশ্বের সব জায়গাতেই টিকা নেয়ার বিষয়ে সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে অনীহা রয়েছে। দেশে যারা টিকা নেয়ার ব্যাপারে দ্বিধায় রয়েছেন তাদেরকে সচেতন করে টিকা প্রদান করতে পারলে একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে টিকা দেয়া যাবে, যা হবে সন্তোষজনক। ধর্ম প্রচারকদের টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তাদের দেখে এবং তাদের কথা শোনে বহু ভক্ত-অনুরাগী টিকা নিতে উৎসাহ বোধ করবেন। শুধু অ্যাপস এর মাধ্যমে করোনার টিকাদানের রেজিস্ট্রেশন সীমাবদ্ধ রাখলে অনেক জটিলতা দেখা দেবে মন্তব্য করে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা গ্রহণের সুযোগ রাখার আহবান জানান। তাছাড়া সাধারণ মানুষকে টিকা গ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজনে উপহার দেয়ায় ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলেও তিনি প্রস্তাব করেন।
করোনার টিকা পাওয়ার অধিকার ধনী-দরিদ্র সবারই সমান উল্লেখ করে ডা. শারমিন বলেন, দরিদ্র মানুষের কাছে যেহেতু স্মার্টফোন নেই সেহেতু তাদের জন্য সহজ কোন পদ্ধতি বের করতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকার বিকল্প পদ্ধতি রাখলেও তা অনেকের কাছেই অজানা। যারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে অপারগ তাদের প্রতিবেশী তরুণরা সাহায্য করতে পারেন। সবমিলিয়ে একটা সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন, সবাইকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে। সব টিভি চ্যানেলগুলোতে ঘুরেফিরে মন্ত্রী-এমপিদের একই বিষয় দেখানো হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে সাধারণ মানুষের টিকাগ্রহণ ধারণ করে দেখানো হলে অন্যরাও তাতে উদ্বুদ্ধ হবেন। মানুষ যাতে নানা মানুষের নানা কথায় বিভ্রান্ত না হয় সেজন্য জাতীয়ভাবে প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে কোন বিভাগে কতজন নিবন্ধন করেছেন, টিকা নিয়েছেন ইত্যাদি জাতিকে অবগত করতে হবে। টিকা নিয়ে সচেতনামূলক প্রচারণায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশী স্বনামধন্য চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞ যারা বিভিন্ন ফোরামে কথা বলে দেশের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেন তাদেরকে সরকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে রাখতে পারেন।