টিকা আসায় উচ্ছ্বাস, ফলপ্রসূ পদক্ষেপ প্রত্যাশা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বিদায়ী বছরে সারাবিশ্বকে বিপর্যস্ত করে ছেড়েছে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। চীন থেকে এ ভাইরাস ছড়ানোর পর থেকেই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল ভ্যাকসিন বা টিকা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের গবেষকরা নিরলস কাজ করে বছরশেষে বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছেন করোনার টিকা। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তৈরি করা টিকা তাদের ভারতীয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে পাচ্ছে বাংলাদেশও। এরই মধ্যে সেই টিকার ২০ লাখ ডোজ উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে ভারত সরকার । গত বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ওই টিকার প্রথম চালান এসে পৌঁছায়। তারপর এই টিকা নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁওয়ের ইপিআই স্টোরে । এখান থেকেই এই টিকা যাবে প্রয়োগ কর্মসূচিতে।
ভারত থেকে আসা এ টিকা নিয়ে দেশের মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। ইতোমধ্যে সভা-সেমিনার থেকে চায়ের দোকান—সর্বত্র টিকা নিয়ে আলোচনা চলছে। উঠে আসছে নানা মতামত। তবে টিকা গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপেক্ষারও শেষ নেই। সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই টিকা প্রথমে চিকিৎসক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ করোনাকালের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের দেয়া হবে। সরকার টিকার মান নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘ফার্মাকোভিজিল্যান্স প্রটোকল ফর কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন’ শীর্ষক প্রটোকলও প্রণয়ন করেছে। করোনার টিকা আসায় উচ্ছ্বসিত রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বলছিলেন, ‘আমরা তো করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছি। তবে টিকা পেলে আমাদেরও ভয় কেটে যাবে। যদিও শুনছি, টিকা ব্যবহারে ঝুঁকি আছে। তাই আমার অনুরোধ যেন, টিকা ব্যবহার করে কেউ অসুস্থ না হয়, সে বিষয়টি আগে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।’ বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, ‘সাংবাদিক, পুলিশ ও চিকিৎসকদের মতো্ই সাধারণ মানুষের জীবন মূল্যবান। তাই বিশেষ শ্রেণির মানুষকে আগে টিকা দিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি করা ঠিক হবে না।’
বেটার লাইফ হসপিটালের স্পেশালিস্ট ইন নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম ডা. সেলিনা সুলতানা বলেন, ‘আমরা ফ্রন্টলাইনে কাজ করি বলে ঝুঁকিটাও বেশি থাকে। সে জায়গা থেকে করোনার ঝুঁকি মোকাবিলা করেই চলছি। টিকার তো প্রয়োজন আছেই, তার আগে এর সাইড ইফেক্টের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।’ গণমাধ্যমকর্মী অর্বাক আদিত্য টিকা প্রদানের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর ভ্যকসিন নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হচ্ছে। সব কিছু ছাপিয়ে, অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বাংলাদেশেও ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হবে। গণমাধ্যমকর্মীদের আগে ভ্যাকসিন দেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে, এটি আনন্দের। তবে আমি বলবো সবাইকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে টিকা দিতে হবে। আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে মানুষের মাঝে যে আলোচনা আছে, সে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।’ গত পরশু ঢাকায় পৌঁছেছে ভারত সরকারের দেয়া উপহার ২০ লাখ ডোজ করোনার টিকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাতিল সিরাজ মনে করেন, ‘করোনার টিকা বিশেষ শ্রেণির মানুষের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণি-পেশার মানুষের আগে প্রয়োজন। তবে এর আগে টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সঠিকভাবে করা উচিত। যেন ব্যবহার করার পরে নতুন সংকট তৈরি না হয়।’
বিশেষ শ্রেণির নয়, আগে খেটে খাওয়া মানুষকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখে টিকা দিতে হবে বলে অভিমত বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ রায়ের। এই ছাত্রনেতা বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমের খবরে জানতে পেরেছি, বিশেষ শ্রেণির মানুষকে প্রথমে টিকা দেয়া হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি এ করোনাকালে খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষকরা দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়েছেন। অথচ সে মানুষগুলো টিকা পাওয়ার অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। এজন্য আমরা বলতে চাই, শুধু বিশেষ শ্রেণিকে নয়, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ মানুষকে করোনার টিকা দিতে হবে।’
দিলীপ রায় বলেন, ‘দেশীয়ভাবে টিকা উৎপাদনের বিষয়ে সরকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, যেন দেশের শতভাগ মানুষের টিকা প্রাপ্তির অধিকার সরকার নিশ্চিত করতে পারে।’ নাম প্রকাশ না করে বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) বলেন, ‘আমরা তো ফ্রন্টলাইনার হিসেবে মানুষের সঙ্গে কাজ করি। ঝুঁকি তো আছেই, সেক্ষেত্রে টিকা পেলে আমরা মানসিকভাবে ভালো বোধ করবো। একইসঙ্গে কাজ করার আগ্রহও বাড়বে। তবে টিকার প্রয়োগ নিয়ে আগে দেশে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারের শতভাগ চেষ্টা আছে বলেও আমরা বিশ্বাস করি।’ সম্প্রতি করোনার টিকা সংক্রান্ত এক সভায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন যারা গ্রহণ করেছেন শারীরিকভাবে তাদের বড় কোনো সমস্যা এখনো দেখা দেয়নি। তবে দেশে ভ্যাকসিন নেয়ার পর কারও শরীরে কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সবাইকে টেলিমেডিসিন সেবা দেবে সরকার। ভ্যাকসিন কীভাবে মানুষকে দেয়া হবে সে প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ‘ঢাকার চারটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল- কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের মধ্য থেকে ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে দেয়া হবে। এরপর সাতদিন সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা হবে। সাতদিন পর্যবেক্ষণ শেষে অন্যদের ভ্যাকসিন প্রয়োগের কাজ শুরু করা হবে।’