অন্ধকারে আশার আলো অক্সফোর্ডের টিকা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনা মহামারিতে আতঙ্কিত দেশের মানুষের কাছে ‘অন্ধকারে আশার আলো’ হয়ে এসেছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার করোনা ভ্যাকসিন। পরিবহন খরচসহ প্রতিডোজ পাঁচ ডলারে কেনা টিকায় দেশের লাখো কোটি মানুষের প্রাণ রক্ষা হবে এমন প্রত্যাশা নিয়ে খুব সহসাই রাজধানীসহ সারাদেশে টিকাদান কার্য়ক্রম শুরু হবে।
দেশে করোনার টিকা কবে আসবে, কোন দেশের (চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, বাংলাদেশ) উৎপাদিত টিকা আসবে, আদৌ আসবে কিনা ইত্যাদি নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) বেলা ১১টা ২০ মিনিটে এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ ফ্লাইটে সিরামের উৎপাদিত ভারত সরকারের উপহার ২০ লাখ ডোজ টিকার চালান ঢাকায় এসে পৌঁছায়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক শুভেচ্ছা উপহার গ্রহণ করেন। বিমানবন্দর থেকে ২০ লাখ ডোজ করোনার টিকার চালান তেজগাঁও ইপিআই স্টোরে সংরক্ষণ করা হয়। এর মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধী টিকা কার্যক্রম বাস্তবায়নের সূচনা শুরু হয়। এ ছাড়া ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে সরকারের কেনা ৫০ লাখ ডোজ টিকা দেশে আসবে ২৫ জানুয়ারি। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সন্মতি সাপেক্ষে যেকোনো দিন রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে সুশীল সমাজের ২০ থেকে ২৫ জনকে টিকা প্রদানের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে করোনার টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধনের পরবর্তী দিনে ড্রাই রান অর্থাৎ পরীক্ষামূলকভাবে চারটি হাসপাতাল ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। এগুলো হলো- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল। এ চারটি হাসপাতালে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে পরীক্ষামূলকভাবে টিকা দেয়ার লক্ষ্য হাতে নেয়া হয়েছে। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুসারে টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে কিনা তা এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করে দেখা হবে। এরই মধ্যে বেক্সিমেকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে চুক্তি অনুযায়ী জেলাগুলোতে টিকা পৌঁছে দেয়া হবে।
স্বাস্থ্যসচিব মো. আবদুল মান্নান জানান, ভারত সরকারের শুভেচ্ছা উপহারের ২০ লাখ ও বাংলাদেশ সরকারের কেনা ৫০ লাখ ডোজ মিলিয়ে মোট ৭০ লাখ টিকার মধ্যে প্রথম মাসে ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেয়া হবে। দ্বিতীয় মাসে ৫০ লাখ এবং তৃতীয় মাসে আবার ৬০ লাখ নাগরিককে টিকা দেয়া হবে। প্রথম মাসের ৬০ লাখের দ্বিতীয় ডোজ সংরক্ষিত থাকবে এবং প্রথম মাসে টিকা পাওয়া ব্যক্তিরা ফের তৃতীয় মাসে পাবেন। স্বাস্থ্যসচিব আরো জানান, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি (সম্ভাব্য) থেকে উপজেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। পরবর্তীতে সারাদেশে কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সম্পন্ন হয়েছে। টিকা সংরক্ষণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে কোল্ড স্টোরেজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
করোনার টিকা নিয়ে নানা কথা প্রচলিত থাকলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের সকলেই অক্সফোর্ডের টিকা নিরাপদ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) সফল বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি রয়েছে। করোনার টিকা নতুন ধরনের হলেও এ কার্যক্রমে সফলতা আসবে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোশতাক হোসেন সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘পৃথিবীতে করোনার যে কয়েকটি টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে সবগুলোই নিরাপদ বলে প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। যেকোনো টিকা দেয়ার পর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতেই পারে।’ নরওয়েতে টিকা দেয়ার পর মৃত্যু কিংবা ভারতে মৃত্যু ও অসুস্থতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘নরওয়েতে টিকা নেয়ার পর মৃত্যুর ঘটনায় দেশটির স্বাস্থ্যবিভাগ সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, টিকার কারণে নয়, যেসব বয়স্ক রোগীকে টিকা দেয়া হয়েছিল তারা আগে থেকেই অন্যান্য রোগে ভুগছিলেন। এ ছাড়া টিকা দেয়ার সময় বাদে অন্যান্য সময়ের তুলনায় দেখা গেছে, মৃত্যু সংখ্যায় খুব বেশি ফারাক নেই।’ ভারতে টিকা দেয়ার কারণে কোনো মৃত্যু হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভারতে টিকা দেয়ার পর কয়েকশ লোকের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কয়েক লাখ লোকের মধ্যে এটি হতেই পারে। কি কারণে তাদের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ করোনার টিকা নিয়ে তিনি খুবই আশাবাদী বলে জানান ড. মোশতাক হোসেন।
গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ভারতে উৎপাদিত টিকা প্রাপ্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে চিঠি দেন। একই উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান ও এমডি বরাবর চিঠি দেন। পরবর্তীতে ৫ নভেম্বর তিন কোটি ডোজ টিকা ক্রয়ের লক্ষ্য বাংলাদেশ সরকার, সিরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন ক্রয়ের সমঝোতা স্মারক সিই হয়। প্রতি ডোজ টিকার মূল্য চার ডলার এবং পরিবহন খরচ এক ডলারসহ প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়বে পাঁচ ডলার।