অস্বীকার করেও তার পথে হাঁটছেন কেন?

0

আবু রূশদ
মানুষটিকে সচরাচর কেউ হাসতে দেখেননি। প্রখ্যাত ফটোসাংবাদিক লুৎফর রহমান বীণু শুধু একটি ছবি তুলতে পেরেছিলেন যেখানে তাকে হাসতে দেখা যায়। কঠোর, কঠিন এক সৈনিকের ছায়া ছিল মানুষটির মুখাবয়বে, চলায়, আচরণে। তার পরও কী যে হলো? মাত্র বছরচারেক রাজনীতির মাঠে থেকে কাঁপিয়ে গেলেন পুরো দেশ, রেখে গেলেন একসমুদ্র ভালোবাসা। ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ বছর রাজনীতিতে এপথ-ওপথ করে যারা যেটুকু জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা ও সর্বোপরি জাতিগত, কৌশলগত দিকনির্দেশনা দিয়ে যেতে পেরেছেন, চার বছরের রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রেই তা ছাপিয়ে গেছে। এ এক বিস্ময়, মেসমেরাইজিং এক নেতৃত্বের অবাক করা বাস্তবতার ইতিহাস।
জেনারেল জিয়া। মিলিটারি পদবিটির সাথে কি হাটে, মাঠে, ঘাটের মানুষের পথচলার সংগ্রামটুকু সমান্তরালে পথচলে? ঘোর আঁতেলেকচুয়াল বিন্যাসে নাক হয়তো উঁচু করে ইউটোপিয়ার নেশাক্রান্তরা বলতেই পারেন- না। কিন্তু জিয়ার সামরিক পদবিটিও আজ রাজনীতির মেঠোপথের সঙ্গী। এটাই বাস্তবতা। এটাই জাতীয়তাবাদ। এটাই এ দেশের সোঁদা মাটির গন্ধে ভরা, কোনো প্রভুর সহায়তার বাইরে থাকা কোটি কোটি বাংলাদেশীর হৃদয়ের আকুলতা। এটাই ওই সৈনিক থেকে রাজনীতিবিদ মানুষটির রাজনীতির মাঠে ক্ষণিকের পথপরিক্রমায় গড়ে ওঠা মহাকালের সফলতা।
জিয়া আজ নেই। জিয়ার তৈরি রাজনৈতিক দলটিও আজ নানাভাবে ক্ষতবিক্ষত। কেন, কার জন্য সেই প্রশ্ন ইতিহাসের কাছে করার চেয়ে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার কাছে সমর্পণ করাই বেশি শ্রেয়। ছিন্নভিন্ন করে, খুবলে চামড়া উঠিয়ে সব শেষ করে দেয়ার নেশায় যত না মত্ত ঘৃণার চাদরে মোড়া শ্বাপদকুল, তার চেয়ে একটি ক্ষুদ্র দেশের মাথা উঁচু করে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিক শক্তি নিঃশেষ করে দেয়ার প্রক্রিয়াই হলো আজকের পরিণতি। এটা এক দিনে ঘটেনি। যে দিন জিয়া হাল ধরে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পররাষ্ট্রনীতি, সমরনীতি হবে স্বাধীন ও মাথা উঁচু করে পৃথিবীতে স্বাতন্ত্র্য জানান দেয়ার, সে দিন থেকেই শুরু হয়েছে ওই জীবনকাঠিটিকে হায়েনার ধারালো দাঁত দিয়ে খুবলে খাবার প্রক্রিয়া।
এক, দুই, তিন করে সফলও হয়েছে সেই হায়েনারা। চার বছরের মধ্যেই জিয়ার শরীরে বুলেটের ব্রাশফায়ার করেছে তারই সঙ্গী, সাথী কমরেডদের একাংশ। তারপর তারই হাতে নিয়োগ পাওয়া এক ‘অতিশয় নিরীহ’ জেনারেলের হাতে সূচিত হয়েছে সমান্তরাল জাতীয়তাবাদ উপস্থাপনের মাধ্যমে আধিপত্যবাদ বিরোধী শক্তির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির মহাযজ্ঞ। এর আর কোনো শেষ নেই। বারবার আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে কেবল জাতীয়তাবাদীরাই। দাঁড়িয়েছে তারাই যাদের পাশে কথায় কথায় কোনো প্রভু এসে দাঁড়ায় না। পলাশীর প্রান্তরের মতো প্রভুদের আজ্ঞাবহ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে অনেকেই।
মহা উল্লাসে তাদের আজ বলতে শোনা যায়, জিয়ার দল নেই! জিয়ার নাম নেই! বিমানবন্দর, কলেজ, স্কুল থেকে ওই নাম মুছে গেছে! বেশ খুশি খুশি লাগছে তাদের! আহা, কী আনন্দ আকাশে, বাতাসে! কিন্তু, আসলেই কি তাই? জিয়ার দল দুর্বল হয়ে গেছে, লাখো কর্মী জেলে, মামলা-মোকদ্দমায় কাহিল। তার পরও কি জিয়া নিখোঁজ? জিয়ার দেখানো পথ হারিয়ে গেছে? জেনারেল জিয়া যখন ক্ষমতায় আসীন হন তখন বাংলাদেশে সবেধন নীলমণি হিসেবে ছিল একটি মাত্র সেনা ডিভিশন। বিমানবাহিনীতে ছিল এক স্কোয়াড্রনের মতো জঙ্গিবিমান। নৌ বাহিনীতে ছিল ভারত থেকে দেয়া মান্ধাতার আমলের ‘বিএনএস পদ্মা’র মতো পেট্রোল বোট। মাত্র চার বছর। সেই সশস্ত্রবাহিনী সবাইকে চমকে দিয়ে ঘুড়ে দাঁড়াল। গঠিত হলো পাঁচটি ডিভিশন। চীন, তুরস্ক, আমেরিকা, পাকিস্তান থেকে এলো ট্যাংক, কামান, রাইফেল, মেশিনগান, বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রসহ যাবতীয় সরঞ্জাম। নৌবাহিনীতে এলো চীনা মিসাইল বোট, সাবমেরিন চেজার, টর্পেডো বোট, ফ্রিগেট। বিমানবাহিনীর জঙ্গিবিমানগুলো ঢাকাসহ দেশের আকাশে উড়ে জানান দিলো আমাদেরও সক্ষমতা আছে। মাথা উঁচু করে, সিনা টান করে সাধারণ মানুষ ভাবতে শিখল, আমরা বাংলাদেশী, আমরাও পারি। সশস্ত্রবাহিনীতে অফিসার সঙ্কট দূর করতে দ্রুত কোর্সের পর কোর্স নেয়া হলো মিলিটারি একাডেমিতে। তৈরি হলো হাজারো অফিসার। তাদের পাঠানো হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দক্ষতার সাথে যুদ্ধ করে রক্ষা করল দেশের সীমানা। সেসব অফিসারের অনেকেই ২০০৯ সালের পর সেনাপ্রধান হয়েছেন। বর্তমান সেনাপ্রধানও তাদের একজন। জেনারেল জিয়া যে জাদুর কাঠির বলে মাত্র চার বছরে সেনাবাহিনীতে পাঁচ ডিভিশন দাঁড় করাতে পেরেছিলেন, তারপর বাকি পাঁচ ডিভিশন তৈরিতে আমাদের লেগেছে চল্লিশ বছর। তবে যাই করা হয়েছে তা-ও ওই মানুষটির দেখানো পথ ধরেই। সেই চীন থেকেই এসেছে বেশির ভাগ সমরাস্ত্র, এখনো আসছে। কই, পারলে জিয়ার তৈরি চীনের সাথে, মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্কটা একটু বাদ দিয়ে দিন। ধ্বংস করে দিন সব সম্পর্ক তার তৈরি দলের মতো, যেই দলকে ধ্বংস করার জন্য সব ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাতদিন, যাবতীয় বুদ্ধি বের করায় সব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন! কেউ তো পারলেন না গত চল্লিশটি বছর! সবাইকে তো জিয়ার দেখানো পথেই হাঁটতে হলো, হচ্ছে! তাহলে দাঁড়াল কী? রেমিট্যান্স নিয়ে গর্বের শেষ নেই কারো। কয়েক দিন পরপর মিডিয়ায় সাড়ম্বরে এই রেমিট্যান্সের গল্প আমাদের দেখতে হয়। আমরা সানন্দে দেখি। বলি, মধ্যপ্রাচ্যসহ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী কর্মজীবীদের যাওয়া শুরু হলো কার হাত দিয়ে? কে ওই সব দেশের সাথে তৈরি করেছিল সুদৃঢ় হৃদ্যতার সম্পর্ক? তার নাম কি জিয়া নয়? তিনিই কি ওই সব দেশে লাখে লাখে শ্রমিক পাঠানোর পথ তৈরি করে দিয়ে যাননি?
সেই পথ ধরেই তো এখনো সবাই যাচ্ছে। আসছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। আর সেই ডলারের গল্প আমরা শুনছি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। কই, ওই সব দেশের সাথে সম্পর্ক ছেদ করুন দেখি! যেহেতু জিয়া সেই সম্পর্ক তৈরি করে গেছেন, তাই ওসব তো হারাম, তাই না! কিন্তু পারছেন তো না। তাহলে আবারো কি বলা যাবে না যে, কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে জিয়ার নাম মুছে ফেলতে পারলেও তার তৈরি বৈদেশিক সম্পর্ক থেকেই রেমিট্যান্স আনতে হচ্ছে! হায়! তালিকাটি দীর্ঘ করা যায়। কী লাভ করে? জিয়া অপরাধ করেছিলেন! কী দরকার ছিল তার সেনাবাহিনীর অবয়ব বাড়িয়ে? কী দরকার ছিল সে সময় ভারত-রাশিয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চীনসহ মুসলিম দেশগুলোর সাথে সামরিক ও অন্যান্য সম্পর্ক তৈরির? তিনি যদি তা না করতেন তাহলে তাকে কখনোই জীবন দিতে হতো না। আরাম, আয়াশে গলফ খেলে তিনি সময় কাটাতে পারতেন। তবে, তার দেখানো পথে যারা আজ চাকচিক্যময় জীবন কাটাচ্ছেন, বিশাল পদ-পদবি ভাগ্যে জুটেছে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আসছে দেশে তাদের সবার জীবন হতো মাথা নিচু করে চলার। হয়তো সেটিই ভালো ছিল, ভালো হতো। আধিপত্যবাদের নিগড়ে থাকলেই পরমানন্দে থাকা যেত! মেরুদণ্ডহীন প্রাণিকুলকে দেখে আজ তো তেমনটাই মনে হয়।
লেখক : সম্পাদক- বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল