মূল্যবোধের অভাবে অবক্ষয় বাড়ছে

0

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার উন্নতির বিষয়টি পুরোপুরি সম্পৃক্ত নয়। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে মানবিকতাকে বিচার করা যায় না। এটি পরিবার, সমাজ ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সাথে জড়িত। অর্থ থাকলেই সুখী হওয়া যায় না, যদি না এর সাথে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সম্পর্ক থাকে। মানুষের জীবনে অর্থের প্রয়োজনীয়তা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি মূল্যবোধের অনিবার্যতাও প্রশ্নাতীত। উন্নত বিশ্বের অনেকে দেশ এখন অর্থনৈতিক উন্নতির চেয়ে নাগরিকদের মানবিক মূল্যবোধের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ধারায় জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। বিশ্বের প্রায় দেড় শতাধিক দেশের উপর জরিপ করে এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এর মূল ভিত্তি হিসেবে মাথাপিছু আয়, সামাজিক নিরাপত্তা, সুস্থ গড় আয়ু, মানবিকতা, ল্য নির্ধারণের স্বাধীনতা এবং দুর্নীতির হারকে ধারা হয়। তবে এসব ভিত্তি মানুষের সুখী হওয়ার পুরোপুরি চিত্র না হলেও এগুলো মানুষের সুখী হওয়ার একটা ধারণা তুলে ধরে। আমাদের দেশে মানুষের সুখী হওয়ার েেত্র ঐতিহাসিকভাবেই পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, শান্তি-শৃঙ্খলা ও নীতি-নৈতিকতাকেই মূল ভিত্তি ধরা হয়। দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে এসব মূল্যবোধের চরম অবয় তীব্র আকার ধারণ করছে। ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনের কবলে পড়ে নিজস্ব সংস্কৃতি ও আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারতে যে ধরণের বর্বর ঘটনা ঘটে তার প্রভাব আমাদের দেশেও পড়ছে। কয়েক বছর আগে সেখানে বাসে গণধর্ষনের ঘটনা ঘটার পরপর আমাদের দেশেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে, পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতি তরুণ ও যুব সমাজকে চরমভাবে গ্রাস করে চলেছে। উগ্রতা, পর্ণোগ্রাফি, মাদকাসক্তি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। যে মাদক সব ধরনের অপরাধের মূল উৎস, তা এখন দেশে অবারিত হয়ে পড়েছে। তরুণ সমাজ থেকে শুরু করে প্রায় সবশ্রেণীর মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের যে ঐতিহ্য পাশ্চাত্যে সবসময়ই প্রশংসিত, তা আজ ধসে যেতে বসেছে। শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জে সর্বত্রই মূল্যবোধের অবয় চলছে। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ায় সন্তান-সন্ততির প্রতি অভিভাবকরা বেখেয়াল হয়ে পড়ছে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, কখন ঘর থেকে বের হচ্ছে, ফিরছে, এদিকে অনেক অভিভাবকের মনোযোগ নেই। এক সময় কোনো তরুণী একা ঘর থেকে বের হয়ে কোথাও যাবে, তা কল্পনাও করা যেত না। গেলেও সাথে অভিভাবক থাকতেন। এখন অবলীলায় বাবা-মায়ের অগোচরে অনেক মেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। যার পরিণতিতে অনেক নৃশংস ও বর্বর ঘটনা ঘটছে। ‘ও’ লেভেলের যে মেয়েটি ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হলো তার েেত্র অভিভাবকের দায়িত্বহীনতাও অনেকটা দায়ী। একইভাবে যে ছেলেটি এ ঘটনা ঘটিয়েছে তার পরিবারও দায়ী। তারা তাকে যথাযথভাবে মানুষ করে গড়ে তুলতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পরিবারে অভিভাবকদের এমন দায়িত্বহীন প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় সন্তান যেমন বিপথগামী হচ্ছে, তেমনি বিপদেরও শিকার হচ্ছে। যে ঘটনা ঘটেছে তা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটি পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের যে অবয় চলছে, তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। আমরা আশা করবো, উন্নয়নের পাশাপাশি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সরকার বিশেষ দৃষ্টি দেবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানুষের সুখ-শান্তি, মানবিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তার মাপকাঠি নয়। মানুষের মানবিক উন্নয়নকে পেছনে ফেলে কেবল অর্থনৈতিক উন্নতির পরিসংখ্যান ও জিডিপি বৃদ্ধিকে উন্নতি, সভ্যতা ও মানবিকতার উন্নয়ন হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। যে উন্নয়ন মানুষের মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা লোপ করে, লোভ-লালসা, নিষ্ঠুরতা, অপরাধপ্রবণতা ও অপসংস্কৃতিতে নিমজ্জিত করে সে উন্নয়ন অর্থহীন। আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধির দিকে গভীর মনোযোগ দিলেও মানুষের মধ্যকার মূল্যবোধের অধঃগতির দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। ফলে পরিবার ও সমাজে একের পর এক অকল্পনীয় ও ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চলেছে। খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, মাদকাসক্তি, কিশোর গ্যাং সৃষ্টি থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ ব্যাপারে পরিবার ও সমাজের অভিভাবক শ্রেণী যেমন উদাসীন, তেমনি সরকারও যথাযথ দৃষ্টি দিচ্ছে না। মানুষের মধ্যে এমন একটা প্রতিযোগিতা ও বার্তা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, যেভাবে হোক অর্থনৈতিক উন্নতি করতে হবে। মানুষও সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। মানবিকতা, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতাকে পেছনে ফেলে সুখের মূল উৎস হিসেবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ছুটছে। নিজের সন্তান থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্যরা যে অরতি হয়ে একেকজন বিচ্ছিন্ন মানুষে পরিণত হচ্ছে এবং বিপথে পা বাড়াচ্ছে, সেদিকে খেয়াল করছে না। যদি খেয়াল করতো তাহলে যে ছেলেটি ‘ও’ লেভেলের এক মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছে, এ ধরনের বর্বর ঘটনা ঘটত না।
দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন এখন তীব্র হয়ে উঠেছে। এই বিভাজন হিংসা-প্রতিহিংসা এবং অপরাধমূলক ঘটনাকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। এই বিভাজন দূর করতে না পারলে কেবল অর্থনৈতিক উন্নতির পরিসংখ্যান ও জিডিপি বৃদ্ধি দিয়ে মানুষের মধ্যকার মূল্যবোধের অবয়, নৃশংসতা, বর্বর ও অসভ্য আচরণ প্রতিরোধ এবং পরিবার ও সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা যাবে না। মানুষের মানবিকতা ও মূল্যবোধই যদি না থাকে, তবে উন্নয়ন দিয়ে কি হবে? মূল্যবোধের অবয় ঠেকানো না গেলে যত উন্নয়নই করা হোক না কেন, তা কোনো কাজে লাগবে না। উন্নত বিশ্বে এখন উন্নতির ধারণা বদলে গেছে। দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের মানবিক চেতনার উন্নতির দিকে মনযোগ দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভুটান অর্থনৈতিক ও জিডিপি উন্নয়নের পরিবর্তে মানুষের সুখের উন্নয়নে ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ (জিএনএইচ) নীতি গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে তার মৌলিক কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ, শান্তি ও শৃঙ্খলার উন্নয়নকে মূল ভিত্তি ধরে মানুষের সুখ নিশ্চিতের রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করেছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা এবং শৃঙ্খলার যে ঐতিহ্য তার অবয়ের কারণেই অভাবনীয় ঘটনা ঘটছে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন কমাতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, রীতি-নীতি ও নৈতিকতা ধরে রাখতে হবে। সরকারের তরফ থেকে যেমন উদ্যোগী হতে হবে, তেমনি সামাজ ও পরিবারের অভিভাবক শ্রেণীকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।