বাংলাদেশ ব্যাংক দায় এড়াতে পারে না

0

দেশ থেকে বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচার হওয়া অর্থ দিয়ে বছরে অন্তত চারটি পদ্মাসেতুর মত প্রকল্পের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব। অথর্ পাচার এবং ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুণ্ঠন এবং তহবিল তছরুপের ঘটনা একইসূত্রে গাঁথা। বছরের পর বছর ধরে চলা এই অর্থনৈতিক লুণ্ঠন-দুর্বৃত্তায়নের পেছনে বিভিন্ন তফশিলি ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক, চেয়ারম্যান, পরিচালক থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এমনকি গভর্নর পর্যন্ত যোগসাজশ, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ও দায়িত্ববহীনতার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন অনেক আগে থেকেই। গত একযুগে শেয়ারবাজার লুণ্ঠন, সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপের চার হাজার টাকার জালিয়াতি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, নানা উপায়ে বছরে লক্ষকোটি টাকা পাচারসহ বড় বড় অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি সংঘটিত হলেও এসব কেলেঙ্কারির কোনোটিরই সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, এনআরবি গ্লােবাল ব্যাংক এবং লিজিং কোম্পানি থেকে রিলায়েন্স ফিন্যান্স লি:এর সাবেক এমডি পিকে হালদারদের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দেয়ার মত ঘটনারও সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়নি। সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা এবং লোপাট হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারের কোনো প্রয়াস না থাকায় ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লোপাট অব্যাহত রয়েছে। হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, ব্যাংকের আমানত জমাকারী এখন নিঃস্ব-দেউলিয়া হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতাভুক্ত সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং বিনিয়োগ ও আমানতের স্বার্থ রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু সর্ষের ভেতর ভুত থাকলে তা দিয়ে কোনো ওঝা ভুত তাড়াতে পারেনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক অবস্থা তথৈবচ। রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর নজরদারি ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার দায়-দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে। অর্থমন্ত্রনালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনও এ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ। এখন ভুক্তভোগী আমানতকারীদের দায়ের করা রীটে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ ও রুলে সব গোমর ফাঁস হতে শুরু করেছে। পিপলস লীজিংসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত এক বিনিয়োগকারীর রীটের শুনানি শেষে গত ১৭ ডিসেম্বর দেয়া এক আদেশে বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক বেঞ্চ ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা অর্থনৈতিক দৃর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন’ মর্মে পর্যবেক্ষণ দেন। গত সোমবার (৪ঠা জানুয়ারী) প্রকাশিত রায়ের পূর্ণাঙ্গ আদেশে বলা হয়, সরকার প্রধান যেখানে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করছেন, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক, ডেপুটি গর্বনর, ডিজিএম ও জিজিএমরা ঠকবাজ, প্রতারক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এদেরকে জবাবদিহিতা ও বিচারের সম্মুখীন করতে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের আরো তৎপর হয়ে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহবন জানিয়েছেন হাইর্কোট।
সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও রাষ্ট্রের রিজার্ভ ব্যাংক হিসেবে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ও আমানতকারিদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার মাধ্যমে অসংখ্য আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করে পথে বসিয়ে দেয়ার সামাজিক-অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এড়াতে পারে না। এতদিনে উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণেও এই সত্য বেরিয়ে এসেছে। এখন দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর, বিভাগ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রীটের শুনানি এবং আদালতের পর্যবেক্ষণে পিকে হালদার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে বিআইএফসির পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখতে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক তথ্যাবলী খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। এছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বিআইএফসির কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের আদেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের এই পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনায় আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক দৈন্য, ভঙ্গুরতা, বিশৃঙ্খলা ও দুর্বৃত্তায়নের একটি খন্ডচিত্র বেরিয়ে এসেছে। দেশের আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করে বিনিয়োগ, আমানত এবং টেকসই উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দায়িত্বহীন, ব্যর্থ এবং প্রতারণা-লুটপাটের সহযোগীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনা এবং ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী ও আমানত ফেরত দেয়ার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।