সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে অপ্রতিরোধ‌্য দালালচক্র

0

সাতক্ষীরা সংবাদদাতা॥ সাতক্ষীরার তালা উপজেলা সদরের শফিকুল ইসলাম তার স্ত্রী শাহারিয়া সোমাকে (২৭) নিয়ে এসেছেন সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে। বেশ কয়েকদিন ধরে পেটের ব‌্যথায় ভুগছিলেন সোমা। চিকিৎসক তাকে এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম করতে বলেন। স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরোনোর পর এক নারী তার কাছে প্রেসক্রিপশনটি দেখতে চান। প্রেসক্রিপশনটি দেখে ওই নারী শফিকুল ইসলামকে বলেন, ‘মামা সদর হাসপাতালের এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন নষ্ট। বাইরের এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার ফল ভালো আসে। সেখানে দেখালে খরচও কম হবে।’ স্ত্রীর অবস্থা খারাপ থাকায় সহজেই প্রভাবিত হয়ে পড়েন শফিকুল। ওই নারীর পরামর্শ অনুযায়ী শহরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দেড় হাজার টাকায় এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম করে আসেন। পরে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন দুটো পরীক্ষাই হাসপাতালে হচ্ছে মাত্র ৫২০ টাকায়। পরে তিনি জানতে পারেন ওই নারীর নাম রাশিদা বেগম। তিনি দালাল চক্রের সদস্য, হাসপাতালের কেউ না।
একই ধরনের অভিযোগ করেন সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুরের আমির হোসেন। তিনি জানান, তার এক ছোট বোন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। হাসপাতালে প্রতিটি পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও দালালেরা তাকে বাইরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে পরীক্ষার জন্য প্রভাবিত করেন। এমন অভিযোগ সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে গেলে প্রতিদিন কয়েশ’ মিলবে। সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত এসব অভিযোগের সত‌্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে একাধিক দালাল চক্র সক্রিয়। দালালদের প্রতিহত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে জনবল সংকটের কারণে প্রতিহত করা সম্ভাব হচ্ছে না। সবার সযোগিতা প্রযোজন।’
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, দালালেরা প্রথমে নিজেদের হাসপাতালের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেয়। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কথা বলে রোগী ও স্বজনদের উন্নত চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ভর্তি হওয়া রোগীদের কৌশলে জানিয়ে দেয় হাসপাতালের চিকিৎসা সামগ্রী অচল ও নিম্নমানের। ভুল রিপোর্ট আসে। তাদেরকে প্রভাবিত করে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নিয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের সঙ্গে দালালদের সখ্য রয়েছে। ভুক্তভোগীরা জানান, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকের নিয়োগ করা দালালদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবা। তারা রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় কর্তৃপক্ষও অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা প্রতিনিয়তই এভাবে দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন। সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী নিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লিনিকে ভর্তি করা থেকে শুরু করে রোগীর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে প্রভাবিত করে এসব দালাল।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দালালদের দৌরাত্ম্যে রোগী ও রোগীর স্বজনেরা দিশেহারা। যেখানে রোগী, সেখানেই হাজির হয় দালাল। মূল ফটক থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত গোটা হাসপাতাল জুড়ে রয়েছে তাদের অবাধ বিচরণ ও আধিপত্য। রাজনৈতিকভাবে মদদপুষ্ট স্বেচ্ছাসেবক নাম দিয়ে প্রকাশ্যেও দালালি করছে অনেকে। রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, ‘সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও টিকিট কাউন্টারের সামনে অবস্থান করে দালাল রাশিদা বেগম। হাসপাতালের সবত্রই বিচরণ করে দালাল খোরশেদ আলম। গ্রাম থেকে আসা রোগিদের টার্গেট করে দালাল মুজিবুর রহমান। মেইন গেটে অবস্থান করে দালাল সইদুল ইসলাম। অন্যদিকে কারও তোয়াক্কা না করে সর্বত্র বিচরণ করে দালাল বনি ও শহরের চামড়া পট্টির রাজু।’
রোগীর স্বজনদের অভিযোগ- টিকিট কাউন্টার, জরুরি বিভাগ, প্যাথলজি বিভাগসহ হাসপাতালের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয় তারা। হাসপাতালে ডাক্তার নেই, টেস্ট ভালো হয় না- এমন বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে গ্রামের সহজ সরল মানুষকে ইঞ্জিনচালিত ভ্যান এবং ইজিবাইকে তুলে নাম সর্বস্ব ক্লিনিকে নিয়ে যায় তারা। এসব দালালরা অধিকাংশ সময় হাসপাতালের ভেতরের অবস্থান করে। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে দালালদের প্রতিহত করা সম্ভাব হচ্ছে না। আউটডোরে কন্ট্রোলের জন্য কিছু স্বেচ্ছা সেবক রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যেও দুয়েকজন দালালি শুরু করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। তবু দালালদের কোনভাবে প্রতিহত করা যাচ্ছে না। তাই রোগী ও স্বজনদের আরও সচেতন হতে আহ্বান জানাচ্ছি।’