ভারতের কাছ থেকে কিছুই পেল না বাংলাদেশ

0

গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে রাজনৈতিক মহলসহ নানা মহলে আলোচনা হচ্ছে। সবারই প্রশ্ন, এ বৈঠক থেকে বাংলাদেশ কি পেল, কি অর্জন করল? তিস্তা চুক্তি ও অভিন্ন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা, সীমান্ত হত্যাকান্ড শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিসহ দুই দেশের অসম বাণিজ্য নিয়ে কর্মকান্ডে কি হলো তা নিয়েই মূলত আলোচনা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ বৈঠক থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বলতে কিছু নেই। স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনও হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে ভারতের আভ্যন্তরীণ আলাপ-আলোচনায় দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়া এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধে দিল্লীর সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকা সত্তে¡ও তা চলমান থাকায় আমরা হতাশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন হতাশা প্রকাশ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে বাংলাদেশের অর্জন কী। অবশ্য ভার্চুয়াল বৈঠকের আগে দুই দেশের মধ্যে ৭টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সিইও ফোরাম, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সহযোগিতা, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাইড্রোকার্বন বিষয়ে সহযোগিতা, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাতি সংরক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতা, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল জাদুঘর ও ভারতের জাতীয় জাদুঘঘরের মধ্যে সহযোগিতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ও বরিশালের স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট সংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তি। এসব চুক্তির ধরণ এবং ভার্চুয়াল বৈঠকের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কিছুই পায়নি।
এ কথা সকলেই জানে, ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে যখন যা চেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তা পূরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবিগুলো কেবল আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। বন্ধুত্বের কথা বলে ভারত একতরফাভাবে তার সবকিছু আদায় করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। এক তিস্তা চুক্তির বিষয়টি প্রায় এক দশক ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। করব, করছি এবং দেখছি বলে ভারত তা বাস্তবায়ন করছে না। সীমান্তে হত্যাকান্ড শূন্যে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করা সত্তে¡ও বিএসএফ বাংলাদেশী হত্যা করে চলেছে। এমনকি বাংলাদেশ যখন ৫০তম বিজয় দিবস উদযাপন করছে সেই দিন এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল বৈঠকের আগের দিন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ এক বাংলাদেশী তরুণকে গুলি করে হত্যা করে। এক সপ্তাহ আগেও একই সীমান্তে আরেক বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। এ নিয়ে এ বছর ৪৫ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ। ভারত যে কথা দিয়ে কথা রাখে না এবং নিজের স্বার্থের বেলায় ষোল আনা বুঝে নেয়, তা বারবারই হয়ে যাচ্ছে, অথচ বলা হচ্ছে, দুই দেশের বন্ধুত্ব রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ। এমন একপাক্ষিক বন্ধুত্ব বিশ্বে আর কোথাও আছে কিনা, আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশের দাবীগুলো খুবই যৌক্তিক এবং ন্যূনতম। ভারতের পক্ষে তা পূরণ করা অসম্ভব নয়। কেবল তার সদিচ্ছার প্রয়োজন। এই সদিচ্ছাটুকুও সে দেখাচ্ছে না। উল্টো তার স্বার্থের নতুন নতুন দাবী-দাওয়া নিয়ে হাজির হয় এবং মুহূর্তে তা আদায় করে নিয়ে যায়। ট্রানজিট, করিডোর, স্থল, নৌ ও বন্দর, পানিপথ, স্থলপথ ব্যবহার, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ, সর্বাধিক রেমিট্যান্স আহরণ থেকে শুরু করে হেন কোনো স্বার্থ নেই যা সে আদায় করে নিচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য ভারতের কাছে করিডোর চাইলে তা দিতে নানা টালবাহানা করে চলেছে। নেপালের সাথে বাংলাদেশের দূরত্ব মাত্র ৪৫ কিলোমিটারের একটি করিডোর। এ করিডোরটির অবাধ ব্যবহার করতে দিলে নেপালের সাথে এমনকি ভুটানের সাথেও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক যোগাযোগ পূর্ণোদ্যমে চলতে পারে। ভারত তা দিতে চায় না। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির আলোচনা শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সংযুক্তির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ হয়ে পশ্চিমবঙ্গের হিলি থেকে মেঘালয়ের মেহেন্দ্রগঞ্জে চলাচলের সুযোগ করে দিতে ঢাকাকে অনুরোধ করেছে দিল্লী। অন্যদিকে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড এই ত্রিদেশীয় মহাসড়কে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, উল্লেখিত অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ত্রিদেশীয় মহাসড়ক ছাড়াই বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারে। এক মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করলেই চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সহজেই সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব। এমনকি ভারত যদি নেপালের সঙ্গে যোগাযোগের করিডোরটি উন্মুক্ত করে দেয়, এর মাধ্যমে নেপাল, ভুটান ও চীনের সাথে যোগাযোগ সহজ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের উচিৎ এসব যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকে জোর দেয়া। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবী আদায়ের বিষয়টি এখন সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে। বন্দুত্বের ‘সর্বোচ্চ পর্যায়’, ‘সোনালি অধ্যায়’, ‘রক্তের রাখীবন্দন’ ইত্যাদি কথামালার ফুলঝুরি ছাড়া কিছুই পাওয়ার নেই। বাংলাদেশ যে নিজ উদ্যোগে কিছু করবে, তাতেও ভারত বাধ সাধে। ভারতের বৈরি পানি নীতির কারণে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পানি সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ গঙ্গা ব্যারেজ করার যে উদ্যোগ নিয়েছিল তা ভারতের আপত্তিতে ভেস্তে গেছে। তিস্তায় জলাধার নির্মাণ প্রকল্পেও তার আপত্তির কথা শোনা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশ যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য যে ‘লুক ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ভারতের কারণে স্তিমিত হয়ে গেছে। ভারতের এ ধরনের আচরণ থেকে বোঝা যায়, সে বাংলাদেশকে কেবল নিজ বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে তার আভ্যন্তরীণ যোগযোগ ও স্বার্থ হাসিল করতে চায়। ফলে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকগুলো ভারতের স্বার্থ ছাড়া বাংলাদেশের জন্য অনেকটা অসারে পরিণত হয়েছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশকে একপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে প্রতিবেশীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে পারস্পরিক সমঝোতা, স্বার্থ ও সম্মানজনক সম্পর্ক জোরদারে বেশি মনোযোগী হতে হবে।