লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনাভাইরাসের দীর্ঘ ১০ মাসেও স্বাস্থ্য খাতে কাটেনি বেহাল দশা। করোনার পাশাপাশি এখনো সাধারণ রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে নানা ভোগান্তিতে পড়ছেন। ঢাকাসহ সারা দেশেই এখনো আইসিইউ সংকট রয়েছে। রাজধানীর বাইরে আইসিইউ তো সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া জেলা সদরের অধিকাংশ হাসপাতালই চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী সংকটে। অধিকাংশ হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। যেগুলো রয়েছে সেগুলোও দিনের পর দিন বিকল হয়ে আছে। এসব সমস্যা যেন দেখার কেউ নেই। এদিকে ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে রাজধানীর হাসপাতালগুলো। সুযোগ বুঝে রোগীর পরিবারের কাছ থেকে নানাভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও আছে।
ইউজিসি অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ গতকাল বলেন, শীত আসছে, করোনাসহ নানা রোগের ঝুঁকিও বাড়ছে। আমাদের জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর অবকাঠামোগত সমস্যা দূর করতে হবে। চিকিৎসক, নার্সসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ জরুরি। জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপন করা জরুরি। এজন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে হবে। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। তৃণমূলের স্বাস্থ্যসেবা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত করা গেলে ঢাকার ওপর চাপ কমবে। এতে মানুষ আর্থিকভাবেও কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চিকিৎসকদেরও সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। দুই মাস ধরে কাশিতে ভুগছিলেন জামালপুরের সালেহা বেগম (৮৩)। এর সঙ্গে রয়েছে উচ্চরক্তচাপ, বাতের ব্যথাসহ বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত রোগ। কাশির কারণে জামালপুর থেকে ডাক্তার দেখাতে রাজধানীর আসগর আলী হাসপাতালে আসেন তিনি। তার করোনার উপসর্গ না থাকলেও কর্তৃপক্ষ করোনা টেস্ট করালে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। পরিবারের সন্দেহ হওয়ায় পরের দিন আবার টেস্ট করালে তার করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট দেওয়া হয় ওই হাসপাতাল থেকেই। সালেহা বেগমের ছেলে শাহজাহান আলী বলেন, ‘আমার মা যে চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত চিকিৎসা করান তিনি এই হাসপাতালে কর্মরত আছেন। দুই মাস ধরে মা কাশিতে ভুগছেন, এর সঙ্গে বাতের ব্যথাও বেড়েছে। তাই জামালপুর থেকে মাকে নিয়ে এসে রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছাই। মাকে জরুরি বিভাগে রাখা হয় করোনা টেস্ট করার জন্য, সেখানে করোনা রোগীও ছিলেন। রাত ১২টায় টেস্টের নমুনা নেওয়া হয়। পরের দিন দুপুরে করোনা পজিটিভ রিপোর্ট দেওয়া হয়। দুই মাস কাশি থাকলে তো আর করোনার উপসর্গ হয় না। আমাদের সন্দেহ হওয়ায় ওই হাসপাতালে আবার নমুনা দেওয়াই। পরের দিন রিপোর্ট আসে করোনা নেগেটিভ। আমার ৮৩ বছর বয়সী মাকে ভুল রিপোর্ট দিয়ে করোনা রোগীদের সঙ্গে রেখে তার জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’ শুধু এই রোগীই নন, চিকিৎসা নিতে এসে এমন ভোগান্তিতে পড়ছেন অন্য সাধারণ রোগীরাও। করোনা টেস্ট সনদ ছাড়া রোগী দেখছেন না চিকিৎসকরা। সরকারি হাসপাতালে জরুরি রোগী নিয়ে গেলে ভর্তির আগে তার করোনা নেগেটিভ সনদ চাওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি করে করোনা টেস্ট না করিয়ে জরুরি রোগীকে নিয়ে গিয়ে আগে করোনা টেস্ট করাতে বলা হচ্ছে। তিন মাস আগে ব্রেন স্ট্রোক করেছিলেন নাজমা বেগম। ফলোআপ চিকিৎসা চলছে তার। প্রতি মাসে চিকিৎসক দেখাতে হয় তার। তার ছেলে ইব্রাহিম হোসেন বলেন, প্রতি মাসে মাকে রংপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে এসে চিকিৎসক দেখাতে হয়। করোনা সনদ ছাড়া রোগী দেখেন না চিকিৎসক। কোনো ধরনের উপসর্গ না থাকলেও প্রতি মাসে মায়ের করোনা টেস্ট করাতে হয়।
ঢাকার বাইরে আইসিইউ যেন সোনার হরিণ : স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, সারা দেশে কভিড-১৯ রোগীদের জন্য আইসিইউ বেড আছে ৫৭৮টি। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনের বাইরে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বাকি বিভাগগুলোতে আইসিইউ বেড আছে ১৮১টি। এই আইসিইউগুলোর অধিকাংশই বিভাগীয় পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবস্থিত। জেলা হাসপাতালে আইসিইউ বেড নেই। ঢাকা শহরের বাইরে ঢাকা বিভাগে আইসিইউ বেড সবচেয়ে বেশি। এ বিভাগে আইসিইউ বেড আছে ৪৭টি। তবে ঢাকার কাছের জেলা নরসিংদী, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলার হাসপাতালগুলোতে কভিড-১৯ রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ বেড নেই। আইসিইউর জন্য অপেক্ষমাণ রোগীর সংখ্যা অনেক বাড়ছে। ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে ঢাকার বাইরের বিশেষ করে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, সাভার থেকে বেশি রোগী আসছে। চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৪টি আইসিইউ বেড রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ১০টি ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও ফরটিস প্রাইভেট হার্ট সেন্টার কুমিল্লায় ২৪টি আইসিইউ বেড রয়েছে। বিভাগের অন্য জেলাগুলোতে আইসিইউ নেই। বরিশালে ১৮টি ও সিলেটে ১৬টি আইসিইউ বেডের সবকটি বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোতে। অন্য জেলার হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড নেই। রাজশাহী বিভাগের ২৮টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ২১টি রাজশাহীতে ও ৭টি বগুড়া জেলায়। বাকি জেলাগুলোতে আইসিইউ নেই। খুলনা বিভাগের ১৮টি আইসিইউ বেড রয়েছে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায়। রংপুর বিভাগের ১৩টি আইসিইউ বেডের মধ্যে রংপুরে ১০টি ও দিনাজপুরে তিনটি রয়েছে। এসব জেলায় জরুরি রোগীদের ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে। ফলে ঢাকার সরকারি ও অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সংকট দেখা যাচ্ছে।
রেফার্ড রোগীদের চাপ ঢাকার হাসপাতালে : সারা দেশের জরুরি রেফার্ড রোগীদের চাপ পড়ে ঢাকার বিশেষায়িত ও সাধারণ হাসপাতালগুলোতে। ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ৫০ শতাংশই সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রেফার্ড হয়ে আসা। নয়তো সেখানে সেবা না পেয়ে ঢাকার হাসপাতালে এসেছেন। কয়েক বছর ধরেই অসংক্রামক রোগের মধ্যে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। কিন্তু জেলা সদরের হাসপাতালগুলোতে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৩০০ শয্যায় এই রোগীর চাপ সামলানো অসম্ভব। হাসপাতালের আশপাশে বিভিন্ন ভবনের বারান্দায় সারা বছর থাকতে দেখা যায় ক্যান্সার রোগী ও স্বজনদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ক্যান্সার রোগীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যে বড় একটি অংশ দেশের বাইরে চিকিৎসা করান। উচ্চবিত্তরা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্যে চিকিৎসার জন্য যান। মধ্যবিত্তরা ভারতে যান ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য। যাদের অন্য দেশে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই তারা রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে অসহায় পরিস্থিতিতে থাকেন। খুলনায় পশু চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন নিয়াজ হোসেন (২৮)। মোটরসাইকেল নিয়ে পাশের উপজেলায় যাওয়ার সময় হঠাৎ রাস্তার একপাশ থেকে কুকুর দৌড় দিলে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। পায়ে আঘাত পেলে এক্সরে করে দেখা যায় হাড় ভেঙে গেছে। প্লাস্টার করে বাড়ি ফেরার মাসখানেক পর দেখা যায় পায়ে ইনফেকশন হয়ে গেছে। চিকিৎসক দেখে বলেন পা না কাটলে এই ঘা ওপরের দিকে উঠবে। এই রোগীকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতালে) রেফার্ড করে দেন। করোনার এই পরিস্থিতিতে রোগী নিয়ে খুলনা থেকে ঢাকায় আসেন নিয়াজের স্বজনরা। ঢাকায় থাকার জায়গা না থাকায় বিপাকে পড়েন তারা। এরপর পঙ্গু হাসপাতালে তার অপারেশন সম্পন্ন হয়।
সংকট চিকিৎসক-নার্সের, যন্ত্রপাতিও বিকল : ৫০ শয্যার পাবনার চাটমোহর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৩২টি। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ১৫ জন। এই উপজেলার তিন লাখের বেশি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের। শুধু এই উপজেলা নয়, সারা দেশের চিকিৎসক, নার্স সংকটের চিত্র একই। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) হিসাব অনুযায়ী, দেশের সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে ৭৫ হাজার চিকিৎসক ও ৩২ হাজারের মতো নার্স রয়েছেন। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ২ হাজার ২৬৭ জন মানুষের জন্য রয়েছেন একজন চিকিৎসক। এ ছাড়া ৫ হাজার ৩১৩ জন মানুষের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বে রয়েছেন একজন নার্স। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) করোনা ওয়ার্ডে রোগী বাড়ছে। হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডগুলোও করোনা পূর্ব রূপে ফিরেছে। ওয়ার্ড ছাপিয়ে রোগীদের স্থান হচ্ছে বারান্দায় খোলা জায়গায়। তাদের সেবা দেওয়ার জন্য নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার-আয়া। বহিরাগত ১২৪ জন বুয়া পেটেভাতে কাজ করে ফুটফরমায়েশ করে রোগীদের। অন্যান্য দিন কালেভাদ্রে ডাক্তার পাওয়া গেলেও শুক্র-শনিবার এই হাসপাতাল থাকে প্রায় ‘ডাক্তার শূন্য’। ডাক্তার না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের কার্যক্রম পাঁচ মাস ধরে বন্ধ। আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর চালানোর জন্য পদ তৈরি করলেও বিশেষজ্ঞ পদায়ন হয়নি আজও। হাসপাতালের দুটি অত্যাধুনিক সিটি স্ক্যান মেশিন, এমআরআই, এনজিওগ্রাম, ক্যান্সার রোগ পরীক্ষার দুর্বল কোবাল্ড-৬০-সহ জটিল রোগ পরীক্ষার কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে আছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপপরিচালক ডা. মুখলেসুজ্জামান হিরো বলেন, জনবহুল বাংলাদেশে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী সংকট আছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও সদিচ্ছা আছে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু বক্তৃতা বিবৃতি নয়, বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তৃণমূলে হাসপাতালের নানা সংকট কাটাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনের সবাইকে নিয়ে এর সমাধান করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সংকট আছে। করোনা বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রুত আইসিইউ বাড়াতে হবে। বন্ধ হওয়া করোনা হাসপাতালগুলো আবারও চালু করতে হবে। করোনা শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই যেমন সচেতন ছিলেন, এখনো সেই সচেতনতা বাড়াতে হবে। সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।