ঝিনাইদহে অরণ্য কেয়ারের ফাঁদে অর্ধলাখ গ্রাহক, তিন কোটি টাকা হাতিয়ে পলায়ন

0

স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহ ॥ ঝিনাইদহে ‘অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ভুঁইফোড় বেসরকারি সংস্থা গ্রাহকের তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে। পড়ে আছে অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের শাখা অফিস, আঞ্চলিক অফিস ও প্রধান কার্যালয়। এসব কার্যালয়ে ঝুলছে বড় বড় তালা। চোখ ধাধানো বড় বড় সাইনবোর্ড থাকলেও নেই অফিস সহকারী, সুপার ভাইজার ও নির্বাহী পরিচালক। এতে ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, শৈলকুপা ও হরিণাকুন্ডু এলাকার হাজারো গ্রাহক পথে বসেছেন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন ওরফে রানা মন্ডল ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের মান্দিয়া গ্রামের মৃত আইজুদ্দিন মন্ডলের ছেলে। তার স্ত্রী উম্মে মোমেনিন ওরফে ইভা অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক ছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ভাষ্যমতে, প্রতারক সংস্থাটি আনুমানিক ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন ওরফে রানা মন্ডল স্বীকার করেছেন গ্রাহকদের ১০ লাখ টাকা তার কাছে আছে। আগামী বর্ষা মৌসুমে এই টাকা তিনি ফেরৎ দিবেন।
গ্রাহকদের অভিযোগ, জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণের কাজ করার কথা বলে প্রতিষ্ঠানটি শৈলকুপায় অফিস খুলে বসে। এরপর তারা প্রাণিজগৎ ধ্বংস এবং দুর্বিসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা রক্ষায় সচেতন করাসহ ফ্রি গাছ রোপন ও সেলাই প্রশিক্ষণের কথা বলে সদস্য সংগ্রহ করতে থাকে। সদস্যদের কাছ থেকে ২’শ টাকা থেকে ৩’শ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা করে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নেয় অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের কর্মীরা। এ ভাবে প্রায় অর্ধলাখ গ্রাহকের টাকা লুট করা হয়। সংগঠনটি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা শহরের কবিরপুরে চোখ ধাধানো সাইনবোর্ড লাগিয়ে দোতলায় অফিস নিয়ে জনবল নিয়োগ দিয়ে শুরু করে সদস্য সংগ্রহ। শৈলকুপার শেখপাড়া বাজারে একটি বহুতল ভবনের চারতলাতে খোলা হয় অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়। আর হরিণাকুন্ডু উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের মান্দিয়া বাজারে খোলা হয় প্রধান কার্যালয়। এসব অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ নিয়োগ করা হয় সুন্দরী নারীদের। তারা গাছের চারা বিতরণ, সেলাই প্রশিক্ষণ ও বিনামূল্যে সেলাই মেশিন বিতরণ আর স্বল্প সূদে দীর্ঘ মেয়াদী লোন এবং বয়স্ক ভাতার কথা বলে শুরু করে ইউনিয়নে ইউনিয়নে সদস্য সংগ্রহ ও সঞ্চয় নেয়া। একটি গাছ আর জৈব সারের প্যাকেট দিয়ে নেয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। সেলাই প্রশিক্ষণ বাবদ নেয় ২৭০ টাকা। আর ঋণ দেয়ার সদস্য বাবদ নেয়া হয় ৩’শ টাকা করে। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি ৯ মাসে অর্ধলাখ গ্রাহকের কাছ থেকে তিন কোটির অধিক টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ। এছাড়া অরণ্য কেয়ার অফিসে যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। যারা প্রথম মাসের বেতন পেলেও বাকি ৮ মাসের বেতন পাননি। অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনে ফিল্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত শৈলকুপা পৌর এলাকার আউশিয়া গ্রামের তুহিন হোসেন ও হরিহরা গ্রামের পিকুল হোসেন জানান, অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনে চাকুরির সুযোগ আছে জেনে চলতি বছরের শুরুতে ৫ হাজার টাকা জামানত রাখার শর্তে তারা নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ফাউন্ডেশনের সেলাই প্রশিক্ষণের কাটিং মাস্টার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সাতগাছী গ্রামের ঝর্ণা খাতুন জানান, অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনে তিনি ৫ হাজার টাকা জামানত রেখে ১৩ হাজার টাকা বেতনের চাকরি পান। কোন বেতন না দিয়ে এ প্রতিষ্ঠান লাপাত্তা হয়ে গেছে। এমডির কাছে জামানতের টাকা ও বেতন চাইলে উল্টো মামলার ভয় দেখাচ্ছেন বলে জানান তিনি। শৈলকুপার কাচেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের সচিব অসীম কুমার সরকার জানান, কয়েক মাস আগে অরণ্য কেয়ার নামের একটি ফাউন্ডেশন তাকে চিঠি দিয়ে চেয়ারম্যানকে দিতে বলে। এরপর তারা কী কার্যক্রম করেছে তা তিনি জানেন না। অরণ্য কেয়ার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আনোয়ার হোসেন ওরফে রানা মন্ডল জানান, ঝিনাইদহ সমাজসেবা অফিসে সমাজসেবার ওপর কাজ করতে অনুমতির আবেদন করলে তারা তাকে ফিরিয়ে দেন। এরপর তিনি অনুমতি না পেয়ে ঝিনাইদহের শৈলকুপা, মাগুরা জেলা ও কুষ্টিয়ার বিভিন্ন সরকারি অফিসে অবগতিপত্র দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর সচেতন করতে সদস্য সংগ্রহ ও গাছের চারা বিতরণ করেন। শৈলকুপাতে তার ২০ হাজার সদস্য রয়েছে বলে তিনি জানান। পরে এদের কাছ থেকে সেলাই প্রশিক্ষণের নামে ৩৫০ টাকা করে নেওয়া হয়। এভাবে তিনি শৈলকুপা থেকে ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন। বর্তমানে তার কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ থাকায় অফিসও বন্ধ রেখেছেন। ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল লতিফ সেখ জানান, ‘কোন ধরণের নিবন্ধন অনুমতি না নিয়ে এভাবে অর্থ কালেকশন বৈধ নয়, এটা গুরুতর অপরাধ।’ তিনি জেলার আইনশৃঙ্খলা সভাসহ এনজিও সমন্বয় সভাতে বিষয়টি তুলবেন বলে জানান।