বাইডেন বাঙালির মাহাত্ম্য বোঝেন, দিল্লি বোঝে না

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সুগত বসু মনে করেন, বিষয়টা খুবই দুঃখের। ইতিহাসের দৃষ্টান্ত দিয়ে ব্রাত্য বসু বলেন, একমাত্র বাংলাতেই এক ধরনের আন্তর্জাতিকতা আছে। যিনি এই আলোচনার অংশ, সেই বাবুল সুপ্রিয় আবার কোনও মন্তব্য করতে চান না।
তবে কেউ বলুন বা না বলুন, ইতিহাসগত ভাবে এটা সত্যি যে দিল্লি কেন্দ্রীয় সরকারে সেভাবে বাঙালির দাম দেয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারে একদা দাপটের সঙ্গে ক্যাবিনেট মন্ত্রিত্ব করেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, বরকত গনি খান, অজিত পাঁজা, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। এ ছাড়াও ত্রিগুণা সেন বা দেবী চট্টোপাধ্যায়ের মতো কেউ কেউ অতীতে কেন্দ্রীয় সরকারে ক্যাবিনেট মন্ত্রী থেকেছেন। কিন্তু ২০১২ সালের জুলাই মাসে প্রণব রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সেভাবে কোনও বাঙালি কেন্দ্রীয় সরকারে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হননি। তর্কের খাতিরে বলা যায়, প্রণব মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পরেও বাঙালি হিসেবে কয়েক মাসের জন্য রেলমন্ত্রী ছিলেন মুকুল রায়। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তৃণমূল ইউপিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসায় সেই মন্ত্রিত্ব ছেড়ে আসতে হয়েছিল মুকুলকেও।
সেই শেষ। তার পর থেকে কোনও বাঙালিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় এখনও পর্যন্ত পূর্ণমন্ত্রী করেনি দিল্লি। অধুনা মোদী সরকারে যে দুই বঙ্গসন্তান মন্ত্রী, সেই বাবুল সুপ্রিয় এবং দেবশ্রী চৌধুরীরা পূর্ণমন্ত্রী নন। প্রতিমন্ত্রী। বস্তুত, বাবুল প্রথম মোদী সরকারেও প্রতিমন্ত্রীই ছিলেন। দ্বিতীয়বারও তাঁর ‘প্রমোশন’ হয়নি। ইতিহাস বলছে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলেও বাংলা থেকে বিজেপি-র যে দু’জন মন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই তপন শিকদার এবং সত্যব্রত (জলু) মুখোপাধ্যায়ের কেউই ক্যাবিনেট মন্ত্রী ছিলেন না। তাঁরাও ছিলেন প্রতিমন্ত্রীই।
যোগাযোগ করা যায়নি দেবশ্রীর সঙ্গে।
কিন্তু দিল্লির সরকারে বাঙালির বঞ্চনার এই খতিয়ান আবার আলোচনায় আসছে এক প্রতিতুলনার কারণে। আমেরিকার হবু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ক্যাবিনেটে আমেরিকাপ্রবাসী বঙ্গসন্তান অরুণ মজুমদার স্থান পেতে পারেন বলে সে দেশের একাধিক কাগজে খবর বেরিয়েছে। অর্থাৎ, দিল্লি না বুঝলেও বাইডেন বুঝেছেন বাঙালির মাহাত্ম্য। সম্মান করছেন তার কর্মদক্ষতাকে
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’, ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ এবং ‘দ্য স্ট্যানফোর্ড ডেলি’ লিখেছে, বাইডেনের মন্ত্রিসভার সদস্য হতে চলেছেন অরুণ। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ লিখেছে, ‘হবু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং হবু ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস যে এজেন্সি রিভিউ টিম্স-এর তালিকা প্রকাশ করেছেন, তাতে অরুণ-সহ কয়েকজন ভারতীয় বংশোদ্ভূতের নাম রয়েছে’। অরুণের পুরো নাম অরুণাভ মজুমদার। আইআইটি বম্বের প্রাক্তনীর পরিচিতি অবশ্য ‘অরুণ’ মজুমদার হিসাবেই। আইআইটি বম্বে থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলার্স ডিগ্রি পাওয়ার পর অরুণ চলে যান আমেরিকা। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলেতে গবেষণা করেন। বর্তমানে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেটিরিয়াল সায়েন্সের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ের জে প্রিকোর্ট প্রোভোস্টিয়াল চেয়ার প্রফেসরও তিনি। সঙ্গে প্রিকোর্ট ইনস্টিটিউট অব এনার্জির সহ-অধিকর্তা হিসেবেও কাজ করছেন। ২০০৯ সালে সেনেটের অনুমোদন নিয়ে তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রোজেক্ট এজেন্সি-এনার্জি (এআরপিএ-ই)-র প্রতিষ্ঠাতা অধিকর্তা মনোনীত করেন। স্ট্যানফোর্ডের আগে তিনি অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়ায় শিক্ষকতা করেছেন। আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স-সহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি যুক্ত।
অরুণ যদি সত্যিই শেষপর্যন্ত বাইডেন ক্যাবিনেটের অংশ হন, তাহলে বাঙালির অবাধারিত মনে পড়বে, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির আপত্তিতে ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি জ্যোতি বসু। আবার ২০১৯ সালে ব্রিটেনের নির্বাচনে লেবার পার্টি হেরে যাওয়ায় মন্ত্রী হতে পারেননি বঙ্গতনয়া ব্যারনেস চক্রবর্তী। বরিস জনসন না জিতলে তাঁর মন্ত্রী হওয়া নিশ্চিত ছিল। আপাতত তিনি ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের শ্যা়ডো অ্যাটর্নি জেনারেল। সারা দুনিয়ায় বাঙালি মন্ত্রী অতএব, একমাত্র রয়েছেন বাংলাদেশে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী-সহ সব মন্ত্রীই নিখাদ বাঙালি। কিন্তু তার পাশের দেশ ভারতে একজন বাঙালিও গত ৮ বছর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি!
রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্যর কথায়, ‘‘একমাত্র বাংলাই হল সেই রাজ্য, যেখানে এক ধরনের আন্তর্জাতিকতা আছে। এই রাজ্যে রচপাল সিংহ নামের একজন মন্ত্রী হয়েছেন। অর্জুন সিংহ নামে একজন সাংসদ হয়েছেন। অন্য কোনও রাজ্য কি এ ভাবে আন্তর্জাতিকতা দেখাতে পারে? উত্তরপ্রদেশে একজন আদিত্যনাথ সেন বা গুজরাতে একজন সুন্দরলাল চক্রবর্তী মন্ত্রী হয়েছেন, এম নটা দেখানো যাবে না। বাংলায় সেই উদারতাটা আছে। আর কর্মদক্ষতার কথা যদি বলেন, বাঙালির যে সেই কর্মদক্ষতাটা আছে, বাইডেনই তার প্রমাণ। যেমন প্রমাণ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বা অমর্ত্য সেন।’’ ইতিহাসের পাতা উল্টে ব্রাত্যের আরও বক্তব্য, ‘‘১৯১১ সালে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে চলে গিয়েছিল। গোখলের ছাত্র গাঁধী যখন ১৯১৫ সালে অহিংস আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তখনও কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের রাশ বাঙালির হাতে ছিল। ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী কংগ্রেসে যখন সুভাষচন্দ্র বসু জিতেছিলেন, তখন থেকে বাঙালিদের দিল্লিওয়ালারা অপছন্দ করে। সেই ঐতিহ্যই এখনও চলছে।’’
নেতাজির পরিবারের সদস্য, হার্ভার্ডের মাস্টারমশাই সুগত মনে করছেন, ‘‘২১০৪ সাল থেকে দেশের ক্ষমতায় যে দল থেকেছে, তারা হয়তো মনে করেছে বাংলা থেকে পূর্ণমন্ত্রী হওয়ার মতো ট্যালেন্ট নেই। প্রণববাবুর পর গত ৮ বছর কেন্দ্রীয় সরকারে বাঙালি ক্যাবিনেট মন্ত্রী না-থাকাটা খুবই দুঃখের বিষয়। কিন্তু প্রণববাবুর মাপের কোনও নেতাও এখনকার শাসকদলে বাংলা থেকে নেই।’’ পাশাপাশিই প্রাক্তন সাংসদ সুগত বলছেন, ‘‘এবারই তো প্রথম বাংলা থেকে বিজেপি-র ১৮ জন নির্বাচিত হয়ে সংসদে গিয়েছেন। আগে তো কমই ছিল। তাঁদের মধ্যে জলুবাবু নামকরা আইনজ্ঞ ছিলেন। তাঁর হয়তো ক্যাবিনেট মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতাও ছিল। কিন্তু তখন তো বাংলা থেকে মাত্র ২ জন সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন! মনে হয়, বিজেপি বাংলা থেকে ক্যাবিনেট মন্ত্রী করার মতো মাপের মানুষ এখনও পায়নি।’’
সুগতর বক্তব্য মেনে নিয়েও অবশ্য অনেকে বলছেন, প্রণববাবু যখন প্রথম মন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন তিনিও তো এত বড়মাপের নেতা ছিলেন না। এখনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের সকলে যে নিজ নিজ ক্ষেত্রে ‘অ্যাচিভার’, তেমনও নয়। উত্তরপ্রদেশ বা গুজরাতের মতো রাজ্য থেকে যাঁদের ক্যাবিনেট মন্ত্রী করা হয়েছে, তাঁদের অনেকের চেয়ে বাংলার বাবুল নিজের ক্ষেত্রে বড় ‘অ্যাচিভার’। অথচ, তাঁকে পরপর দু’টি সরকারে প্রতিমন্ত্রী করেই রেখে দেওয়া হয়েছে।
দলের একাংশের বাধায় জ্যোতিবাবু প্রধানমন্ত্রী না হতে পারায় মুষড়ে পড়ছিল বাঙালি। সেই সিদ্ধান্তকে প্রয়াত বসু ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে বর্ণনা করায় সে দুঃখ চতুর্গুণ হয়েছিল। তার খানিকটা প্রশমন হয়েছিল প্রণব রাষ্ট্রপতি হওয়ায়। কিন্তু আমেরিকার ক্যাবিনেটে এক বঙ্গসন্তানকে বোধহয় বাঙালিও কল্পনা করেনি। বাইডেন দিগন্তে সেই অরুণের উদয় হলে বিশ্বজোড়া বাঙালির আকাশ আলোকিত হবে বৈকি!