দ্বিপক্ষীয় বিরোধে মন্দার মুখে কয়লা বাণিজ্য

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনা মহামারীর মধ্যে চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার বিরোধের খবর বেশ পুরনো। দুই দেশের এ বিরোধ রাজনীতির সীমা ছাড়িয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে বেশ আগে। বিরোধের কারণে এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে যব আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে বেইজিং। এবার দ্বিপক্ষীয় বিরোধের প্রভাব পড়েছে দুই দেশের কয়লা বাণিজ্যেও। অস্ট্রেলিয়া থেকে জ্বালানি পণ্যটি আমদানিতে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। তবে অস্ট্রেলীয় কয়লা আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দিয়েছে চীন।
জ্বালানি পণ্যবাহী কার্গো চলাচলের তথ্য বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান রেফিনিটিভ জানিয়েছে, চলতি বছরের জুনে অস্ট্রেলিয়া থেকে সব মিলিয়ে ১ কোটি ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন কয়লা আমদানি করেছিল চীন। এর পর থেকে চীন-অস্ট্রেলিয়ার কয়লা বাণিজ্যে বড় ধরনের পতন দেখা দেয়। সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়া থেকে চীনা আমদানিকারকরা জ্বালানি পণ্যটির আমদানি ৩৩ লাখ ১০ হাজার টনে নামিয়ে এনেছে। গত মাসে চীনা আমদানিকারকরা অস্ট্রেলিয়া থেকে ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টন কয়লা আমদানি করেছে।
চীন বিশ্বের শীর্ষ কয়লা উত্তোলনকারী দেশ। তবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেশি থাকায় দেশটি প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কয়লা আমদানি করে। জ্বালানি পণ্যটির আমদানিকারকদের বৈশ্বিক শীর্ষ তালিকায় দেশটি তৃতীয় অবস্থানে। কয়লার মোট বৈশ্বিক আমদানি বাণিজ্যের ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ চীনের দখলে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের শীর্ষ কয়লা রফতানিকারক দেশ। জ্বালানি পণ্যটির মোট বৈশ্বিক রফতানি বাণিজ্যের ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ জোগান দেয় অস্ট্রেলিয়া।
প্রতি বছর চীনে আমদানি হওয়া কয়লার বেশির ভাগ আসে অস্ট্রেলিয়া থেকে। এর মধ্যে আমদানি করা কোকিং কোল চীনের ইস্পাত কারখানাগুলোয় ব্যবহার করা হয়। আর অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা তাপ কয়লা মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোয় ব্যবহার করে চীন। একই সঙ্গে চীনের সিমেন্ট ও সিরামিকস কারখানাগুলোয় ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা তাপ কয়লা।
স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, চীনের শিল্প খাত অনেকাংশেই অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা কয়লার ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে বৈশ্বিক কয়লা বাণিজ্যে চীন-অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। রেফিনিটিভের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুনে চীনের উদ্দেশে কয়লা নিয়ে ১২৪টি পণ্যবাহী কার্গো অস্ট্রেলিয়ার উপকূল ছেড়ে গেছে। অক্টোবরে এ সংখ্যা সাকল্যে ৩৩-এ নেমে এসেছে। চলতি মাসের পরিস্থিতি আরো খারাপ। মাসের প্রথমার্ধে চীনের উদ্দেশে অস্ট্রেলিয়ার উপকূল থেকে সাকল্যে চারটি কয়লাবাহী কার্গো ছেড়ে গেছে।
কয়লা বাণিজ্যে এ মন্দা ভাবের পেছনে দুই দেশের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিরোধকে চিহ্নিত করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। ২০২০ সালের শুরুর দিকে চীন থেকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে নভেল করোনাভাইরাস। বাদ যায়নি অস্ট্রেলিয়াও। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনা সংক্রমণকে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করে। বিশ্বজুড়ে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার জন্য চীনকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো। এ তালিকায় সোচ্চার কণ্ঠ ছিল অস্ট্রেলিয়ার।
শুধু দায়ী করা নয় বরং স্কট মরিসন সরকার করোনা বিস্তারের দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে চীনের বিচারের প্রস্তাব তোলেন। যদিও বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে বরাবরই এ দাবি অস্বীকার করা হয়েছে। করোনা নিয়ে পরস্পরবিরোধী এ অবস্থান চীন ও অস্ট্রেলিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্রমেই শীতল করে তুলেছে। রাজনীতি ছাড়িয়ে বাণিজ্য খাতেও প্রভাব পড়েছে বিরোধের।
অস্ট্রেলিয়া থেকে রফতানি হওয়া যবের ৭০ শতাংশই আমদানি করে চীন। ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে যবের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের আকার ছিল ১০৫ কোটি ডলারের। বিরোধের জের ধরে চলতি বছর অস্ট্রেলিয়া থেকে কৃষিপণ্যটির আমদানিতে শুল্কহার বাড়িয়ে ৮০ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করে বেইজিং। এর জের ধরে অস্ট্রেলিয়া থেকে যব আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেয় চীনা আমদানিকারকরা।
যদিও চীনের দাবি, আমদানি করা যবের চালানে ক্ষতিকারক উপাদান পতঙ্গ পাওয়া যাওয়ায় অস্ট্রেলীয় যব আমদানি সাময়িক কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বেইজিংয়ের প্রতি যবের আমদানি শুল্ক কমানোর আহ্বান জানায় অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু চীন সরকার এ আহ্বানে সাড়া দেয়নি। উল্টো যবের পাশাপাশি গম, তামাসহ আরো কয়েকটি অস্ট্রেলীয় পণ্য আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার বাড়ানো কিংবা সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তাভাবনা করছে বেইজিং। চীনা আমদানিকারকদের এসব পণ্যের বিকল্প আমদানি উৎস খুঁজতে অনানুষ্ঠানিকভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফলে সহসাই দুই দেশের মধ্যে বিরোধ কমছে না, এটা অনুমান করা যাচ্ছে।
এদিকে বিরোধের জের ধরে চীনা আমদানিকারকরা অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যটির দাম কমতে শুরু করেছে। গত শুক্রবার সিঙ্গাপুর ফিউচার এক্সচেঞ্জে ফ্রি অন বোর্ড (এফওবি) চুক্তিতে প্রতি টন কয়লার দাম দাঁড়িয়েছে ১০৪ ডলার ৮৬ সেন্টে। গত চার বছরের মধ্যে এটাই জ্বালানি পণ্যটির সর্বনিম্ন দাম।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, অক্টোবরের শুরুতে চীনা আমদানিকারকরা দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলীয় কয়লা আমদানি ধারাবাহিকভাবে কমিয়ে আনতে মৌখিক নির্দেশনা পায়। ওই সময় প্রতি টন কয়লার দাম ১৪০ ডলারের ওপরে ছিল। নির্দেশনা মেনে চীনা আমদানিকারকরা এখন কয়লা আমদানিতে অস্ট্রেলিয়ার বিকল্প হিসেবে মঙ্গোলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়ার মতো দেশগুলোর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
রয়টার্স, সিএনবিসি ও অয়েলপ্রাইসডটকম অবলম্বনে