ভবদহের দুর্দদশার সুতিকাগার ২১ ভেল্ট স্লুইসগেট /৩ # ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলো সব নিষ্ফল

0

নজরুল ইসলাম মল্লিক, অভয়নগর (যশোর)॥ যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর উপজেলাসহ খুলনার ৩৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ১০ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার নাম ভবদহের ২১ ভেল্ট স্লুইসগেট। অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউনিয়নে ভবদহের সব থেকে বড় এই স্লুইসগেটের ২১টি কপাটই পলি মাটি ভরাট হয়ে বন্ধ হয়ে আছে। স্লুইসগেট দিয়ে পানি প্রবাহিত না হওয়ায় গেট সংলগ্ন শ্রীনদী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী ৩টি নদী ও আমডাঙ্গা খালের অবস্থাও ভয়াবহ। কিন্তু পলি অপসারণের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
জানা যায়, সবুজ বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে ১৯৬০ সালে যশোরের সদর, মনিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলা এবং খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহ নামক স্থানে শ্রীনদীর ওপর নির্মাণ করা হয় ২১ ভেল্টের স্লুইসগেট। পরবর্তীতে ভবদহের ২শ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৮ লাধিক মানুষের মরণ ফাঁদে পরিণত হয় এই ¯ুইসগেট। গেটটিতে কপাট রয়েছে ২১টি। গেটটি দিয়ে শ্রীনদী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী নদীসহ বিল কেদারিয়া, বিল বকর ও বিল আড়পাড়াসহ যশোর ও খুলনা এলাকার মোট ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশন হওয়ার কথা। কিন্তু নিয়ম মেনে গেটগুলো খোলা ও বন্ধ না করায় পলি জমে আটকে যায় গেটগুলো। একারণে ১৯৯৪ সালে বর্ষা মৌসুমে বিল তীরবর্তী আশপাশের কয়েক শ গ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ সময় পানিবন্দি মানুষ আন্দোলন শুরু করলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক ও কারিগরী সহায়তায় ভবদহের পানি নিষ্কাশন প্রকল্প (কেজিডিআরপি) গ্রহণ করা হয়। ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২৫৭ কোটি টাকা। সমুদয় অর্থ ব্যয় হওয়ার পরও কোন ফল পায়নি জলাবদ্ধ মানুষ।
এরপর ২০০৭ সালে ৫৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ২০১০ সালে ৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং দফায় দফায় টিআরএমসহ ছোট ছোট প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়। সর্বশেষ এবছর পানি নিস্কাশনের প্রকল্প তৈরি করে ভবদহ গেটের পাশে শ্রীনদী ড্রেজিংয়ে ৫০ লাখ টাকার কাজ চলমান আছে।
ইতোমধ্যে পলি পড়ে এলাকার পানি নিস্কাশনের একমাত্র মাধ্যম মুক্তেশ^রী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী নাব্যহারা হয়েছে। পলিভরাট নদী দিয়ে পানি নিস্কাশিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় বৃষ্টির পানিতে এলাকার বিলগুলো তলিয়ে গেছে। বিল উপচে পানি ঢুকছে বিল সংলগ্ন গ্রামগুলোতে। দুর্ভোগে পড়েছেন ভবদহাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ। আবার কেউ কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে ঘরের মধ্যে মাচা করে সেখানে থাকছে।
এ উপজেলার বলারাবাদ, বেদভিটা, ডুমুরতলা, আন্ধা, বারান্দী, দিঘলিয়া, কোটা, ডহর মশিহাটি, রাজাপুর, সুন্দলী, ভাটবিলা, সড়াডাঙা, হরিষপুর, ফুলেরগাতী, দামুখালী, দত্তগাতী, জিয়াডাঙাসহ আরও কয়েকটি গ্রামের কোথাও আংশিক আবার কোথাও বেশির ভাগ ঘর বাড়িতে পানি উঠেছে । উপজেলার পানিবন্দি গ্রামগুলো ঘুরে মানুষের দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে। এ সময় গ্রামবাসী জানান, এলাকার রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় অনেক জায়গায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি থেমে গেলেও পানি কমছে না। তারা বলেন, নদ-নদীগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। নদী ও আমডাঙ্গা খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় এলাকার বিলগুলো বৃষ্টির পানিতে ভরে রয়েছে। তারা আরও বলেন, টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় অভয়নগর,মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং যশোর সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের দাবি দ্রুত সময়ের মধ্যে পানি নিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য টিআরএম (টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্টে) প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
অভয়নগর উপজেলার চলশিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাদির মোল্লা জানান, ১৩টি গ্রাম নিয়ে তার ইউনিয়ন। এর মধ্যে ৫টি গ্রামের ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। শ শ ঘরবাড়ি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে এলাকার মানুষ তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে খুবই খারাপ অবস্থায় দিনযাপন করছেন। এ অবস্থা থেকে স্থায়ী সমাধান পেতে হলে ভবদহের স্লুইসগেটের সবকটি কপাট খুলে দিয়ে টিআরএম প্রকল্প চালু করতে হবে। সুন্দলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় বলেন, এ ইউনিয়নে ১৪টি গ্রামের ১৩টির ঘর-বাড়িতে পানি উঠেছে। এলাকার বিলগুলো আগে থেকেই জলাবদ্ধ হয়ে আছে। এসব বিলে দীর্ঘ দিন কোনো ফসলাদি হয়নি। এলাকার হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগে। তিনি আরও জানান, স্থায়ী সমাধানের জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে আমডাঙ্গা খাল এক শ ফুট প্রস্থ সমান্তরাল করে গভীরভাবে খননসহ টিএরএম প্রকল্প চালু করতে হবে। ভবদহ জলাবদ্ধতা নিরসন আন্দোলন কমিটি ও অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এনামুল হক বাবুল বলেন, ভবদহের আশপাশের সব নদী ও আমডাঙ্গা খাল খনন করে উজানের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং বিল কপালিয়াসহ খাল-বিলে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) চালু করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সেচ প্রকল্প চালু করে জলাবদ্ধ এলাকার স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না। তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়ন করা না হলে এ অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে আরও দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে তিনি জানান। পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম এ প্রতিনিধিকে বলেন, নদী থেকে পলি সরানোর জন্য ৫০লাখ টাকা ব্যয়ে খনন কাজ চলছে। জরুরিভাবে পানি নিষ্কাশনের জন্য আমরা বিআইডিসিকে সাথে নিয়ে ভবদহের সংশ্লিষ্ট নদীতে ইলেকট্রিক সেচ পাম্প বসিয়ে জলাবদ্ধ নিরসনের ব্যবস্থা করা হবে। আমডাঙ্গা খালের প্রস্থ ও গভীরতা বাড়িয়ে খাল খননের জন্য দরপত্র গ্রহণ করা হবে। এ মাসের শেষে কাজ শুরু করতে পারবো। তিনি আরও বলেন, পানিবন্দি মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা চিন্তা করে যে কোনো প্রকল্পের মাধ্যমেই হোক পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।