নিরাময় কেন্দ্র যখন অপরাধের কেন্দ্র

0

মাদকাসক্ত রোগীদের সুস্থ করে তোলার জন্য রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন নামে বহু নিরাময় কেন্দ্র লক্ষ করা যায়। এসব নিরাময় কেন্দ্রের কতটি বৈধ লাইসেন্সধারী, আর কতটি তা নয়, সেটা সাধারণ মানুষ জানে না। নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে কী ধরনের চিকিৎসা হয়, মাদকাসক্ত রোগী কতটা সুস্থ হয়, কতদিনে সুস্থ হয় হয়- এসব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। সম্প্রতি রাজধানীর আদাবরে ‘মাইন্ড এইড’ নামের একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে পুলিশের একজন কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এই লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের পর ঔই নিরাময় কেন্দ্রের নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারের কথা-কাহিনী বেরিয়ে এসেছে। এর নাকি বৈধ লাইসেন্সই ছিল না। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা হওয়ার কথা নয়। তাও নাকি ঔই নিরাময় কেন্দ্রে হতো। রোগীদের মারধর করা, বেঁধে রাখা, ঘরে আটক রাখা- এসব ছিল অতি সাধারণ ব্যাপার। এই ঘটনার সূত্র ধরে অন্যান্য নিরাময় কেন্দ্রে সচরাচর যা ঘটে থাকে, তারও একটি চিত্র উঠে এসেছে। জানা গেছে, নিরাময় কেন্দ্রে পেটানোসহ রোগীদের ওপর নানা প্রকার নির্যাতন সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ জন্য পেটানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বাউন্সারও নাকি নিয়োজিত আছে। অনেক নিরাময় কেন্দ্রে। রিমান্ডের আসামিদের ক্ষেত্রে যা করা হয়, মাদকাসক্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও প্রায় তাই করা হয়। মারধর ছাড়াও ওয়াটার থ্যারাপি দেয়া হয়, ডান্ডা বেড়ি লাগানো হয়, আঙ্গুলের ফাঁকে কাঠের শলাকা দিয়ে সজোরে চাপ দেয়া হয়, নখ উপড়ে ফেলা হয় এবং সিগারেটের ছ্যাঁকা পর্যন্ত দেয়া হয়। চিকিৎসার নামে এসব অত্যাচার-নির্যাতন কীভাবে চলতে পারে, সেটা বিস্ময়কর। সুস্থ মানুষও এর ফলে অসুস্থ ও মানসিক রোগীতে পরিণত হতে পারে। শোনা যায়, অনেক সুস্থ মানুষকে পারিবারিক কারণে বিশেষত সয়-সম্পত্তির কারণে এ ধরনের নিরাময় কেন্দ্রে বা মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে জোর করে ভর্তি করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত পাগল বানানো হয়। অত্যাচার-নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনাও অনেকটা স্বাভাবিক।
এ অভিযোগ পুরনো, অধিকাংশ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের বৈধ লাইসেন্স নেই। নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। অথচ, রাধানীতেই এমন বহু নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে, যাদের বৈধ লাইসেন্স নেই। যাদের আছে, তারাও নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায়, লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা ১০৩টি। নিরাময় কেন্দ্রের নামে ব্যবসা করছে এর বাইরেও অন্তত ২০০টি প্রতিষ্ঠান। আর সারাদেশে লাইসেন্সবিহীন নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এত নিরাময় কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৪/৫টি মানসম্পন্ন। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের নামে বা এর অন্তরালে যে অন্য ধরনের ব্যবসাও চলছে, তারও অভিযোগ রয়েছে। মানসিক রোগ চিকিৎসার কেন্দ্রগুলো সম্পর্কেও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। বৈধ লাইসেন্স বেশিরভাগের ক্ষেত্রে নেই। চিকিৎসার মানও ২/৪টি ছাড়া অন্যদের নেই। নিশ্চয় এসব দেখভাল করার কর্তৃপক্ষ আছে। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়ার দায়িত্বই শুধু মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নয়, শর্ত মোতাবেক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত কিনা, তার অবকাঠামোর উপযুক্ততা আছে কিনা, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও চিকিৎসক আছে কিনা- সেসব দেখার দায়িত্বও তার। লাইসেন্স তদারকি, চিকিৎসা পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্বও তার ওপরই বর্তায়। বলা বাহুল্য, এ দায়িত্ব যদি যথাযথভাবে পালন করা হতো, তাহলে অবৈধ বা ভুয়া নিরাময় কেন্দ্র গড়ে ওঠা সম্ভব হতো না এবং অপচিকিৎসা বিস্তৃত হতো না। বলা হয়ে থাকে, লোকবলের অভাবে নিয়মিত দেখা-শোনা, তদারকি ও নজরদারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এটা একটা খোঁড়া যুক্তি বা অজুহাত। লোকবল বাড়াতে অসুবিধা কোথায়? যে লোকবল আছে, তার পারফরমেন্সই বা কী? আংশিক দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা থাকলেও এরূপ নাজুক অবস্থা হওয়ার কথা নয়।
দেশে অসংখ্য প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে শত শত প্রতিষ্ঠানের কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই। সংশ্লিষ্ট দফতর সূত্রে জানা গেছে, ৬ হাজারের কিছু বেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বৈধ লাইসেন্স আছে। লাইসেন্স ছাড়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কত, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না হলেও তা ১০ হাজারের বেশি হতে পারে। লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের সেবার মান নিয়ে যেখানে প্রশ্নের শেষ নেই, সেখানে লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানের সেবার মান কী হতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ইত্যাদি লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। নিরাময় কেন্দ্র কিংবা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান- যাই হোক না কেন, অবশ্যই বৈধ লাইসেন্সধারী হতে হবে। তাদের সেবার মানও যথাযথ হতে হবে। এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই। অবৈধ ও লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠান যারা গড়ে তুলেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিনাবাক্যে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। বৈধ প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা করতে হবে এবং তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়মিত তদারকি ও নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।