মাস্ক বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে ৯ বছরের তরিকুল

0

সাতক্ষীরা সংবাদদাতা॥ ‘আমি ভিক্ষা চাই না, ভিক্ষা করিও না। ভিক্ষা করলে বাবা-মায়ের মানসম্মান চলে যায়। তাই মাস্ক বিক্রি করি। মাস্ক বিক্রির টাকাগুলো তুলে দেই বাবা-মায়ের হাতে। তারা সেই টাকা দিয়ে বাজার করেন, সমিতির কিস্তি পরিশোধ করেন।’ কথাগুলো বলছিল সাতক্ষীরা জজকোর্ট চত্বরে মাস্ক বিক্রি করা ৯ বছরের শিশু তরিকুল ইসলাম। সে শহরের খুলনা রোড মোড় এলাকার মধুমল্লারডাঙ্গী গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে। তরিকুল পলাশপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। তার বাবা পেশায় ভ্যানচালক। শিশু তরিকুল ইসলাম জানায়, তার বাবা ভ্যান চালান, এখন অসুস্থ তাই বাড়িতে বিশ্রামে আছেন। সুস্থ হলে আবার ভ্যান চালানো শুরু করবেন।
সে বলে, আমি মাস্ক বিক্রি করছি। এক প্যাকেটে থাকা ১০০ মাস্ক আমি ক্রয় করি দেড়শ টাকায়। প্রতিটি মাস্ক বিক্রি করি পাঁচ টাকা। দিনে ৪০০-৫০০ টাকার মাস্ক বিক্রি হয়। আমার লাভ হয় ২০০-৩০০ টাকা। এই টাকা তুলে দেই বাবা-মায়ের হাতে। তারা এসব টাকা বাড়ির কাজে লাগান। আমার একটি ছোট সাইকেলের সখ ছিল, কিন্তু বাবা কিনে দিতে পারেননি। সাইকেল থাকলে তাতে চড়ে মাস্ক বিক্রি করতে পারতাম, স্কুলে যেতাম। মাস্ক বিক্রি করতে গিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তরিকুল বলে, একদিন শহরের চায়না বাংলায় এক আন্টি ভিক্ষা করছিলেন। আমি বল্লাম, আন্টি আপনি তো সুস্থ মানুষ, ভিক্ষা করেন কেন। কারও বাড়িতে গেলে তো আপনাকে কাজে নেবে। এই বলতেই সেই আন্টি আমাকে মারপিট করতে আসলো। বল্লো, এক আছাড় দিয়ে নাড়িভুড়ি বের করে দিব। তরিকুল ইসলাম তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মেজো বোনের বয়স ১২ বছর। ছোট্ট বয়সেই পরিবারের হাল ধরেছে ছেলেটি।
সাতক্ষীরা জজকোর্ট চত্বরে কৌতূহল নিয়ে এসব ঘটনা জানার পর তরিকুলকে ব্যবসার পুজির জন্য ২০০ টাকা দেন শ্যামনগর উপজেলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা আমিনুর রহমান বুলবুল। তিনি বলেন, এই বয়সে ছেলেটি পরিবারের হাল ধরেছে, বাবাকে সহযোগিতা করছে। সে বুঝতে শিখেছে ভিক্ষা করা খারাপ, সম্মান নষ্ট হয়। মাস্ক বিক্রি করে টাকা রোজগার করছে ছেলেটি। এটি অন্যদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। জজকোর্টের এক ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতা জানান, ছেলেটি প্রতিদিন মাস্ক বিক্রি করে কোর্টের মধ্যে। অনেকেই ভিক্ষা করে মিথ্যা বলে মানুষদের কাছে টাকা চায়। তবে ছেলেটি ভিক্ষা করে না। মাস্ক বিক্রি করে। তরিকুল ইসলামের বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি লিভার জন্ডিসে আক্রান্ত। একদিন ভ্যান চালালে ১০ দিন বাড়িতে বসে থাকতে হয়। ঠিকমত ভ্যান চালাতে পারি না। যার কারণে পরিবারে অভাব দেখা দিয়েছে। ছেলে তরিকুল পরিবারের এমন অভাব দেখে নিজেই ব্যবসায় নেমেছে। সে খুব শান্ত প্রকৃতির ছেলে।
তরিকুলের মা সালমা বেগম বলেন, বাড়িতে অভাব-অনটন দেখে দুই বছর আগে তরিকুল একদিন আমাকে বলেছিল- ‘বাবা অসুস্থ ঠিকমত ভ্যান চালাতে পারে না। এভাবে কি সংসার চলে। আমি ব্যবসা করলে সংসারটা ভালো চলতো। খেলনা বিক্রি করবো।’ এরপর আমি ওকে ৪০০ টাকা দেই খেলনা কেনার জন্য। তারপর থেকে তরিকুল স্কুলের সময় স্কুলে যায়, পরে খেলনা বিক্রি শুরু করে। তিনি বলেন, তরিকুল এখন পলাশপোল স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ, তাই এখন মাস্ক বিক্রি করে। প্রতিদিন ১৫০-২০০ আবার কোনদিন ৩০০ টাকা আমাকে এনে দেয়। সে টাকাতে সংসার চলে আর সমিতির কিস্তি দেই। ওর একটা সাইকেলের সখ ছিল, কিন্তু কিনে দিতে পারিনি আজও। ওর বাবা অসুস্থ, ঠিকমত ভ্যানও চালাতে পারে না। তাদের প্রতিবেশী ইজিবাইক চালক তরিকুল ইসলাম বলেন, ছেলেটি খুব ভালো, শান্ত স্বভাবের। কখনও কারো সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে বলে আমি শুনিনি। পলাশপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মালেকা পারভীন বলেন, তরিকুল ছেলেটি মোটামুটি মেধাবী। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তবে তার পারিবারিক অবস্থা কেমন আমি জানি না। তাছাড়া করোনাকালে সে মাস্ক বিক্রি করছে- এটিও আমার জানা নেই।