লিখতে গেলেই অশ্রুজলে সাগর ভাসে

0
শান্তনু ইসলাম সুমিত
ছেলেটা জন্ম নেবার পরপরই তার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, বাঁচবে না বোধহয়। কিন্তু তার বাবা সেই শিশু বাচ্চাটিকে তাঁর ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া শুরু করলেন। ফিডারে করে দুধ খাওয়ানোর পাশাপাশি তাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটাও তিনিই করতেন। ছেলেটা ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকলো বাবার আদর যত্নে।
সেদিনের সেই মরণাপন্ন ছেলেটি একদিন মহীরুহু হয়ে গেলেন। হ্যাঁ, আমি আমার বাবা তরিকুল ইসলামের কথা বলছি। আজ থেকে দু বছর আগে যিনি ফিরে গেছেন সৃষ্টিকর্তার কোলে।
ছেলেবেলায় বাবার সাথে দেখা হতো মূলত দুপুর বেলা আর স্কুল ছুটির দিনগুলোতে। আমাদের সময় যারা জন্ম নিয়েছিলো, তাদের সবারই বাবাদের সাথে কিছুটা দূরত্ব ছিলো, ছিলো ভয় মেশানো শ্রদ্ধা। তবে যোগাযোগ একটা খুব ভালোমতো ছিলো, সেটা হচ্ছে আব্বুর পা টিপে দেয়া। খুব ছোটবেলায় মশারি টানানোর কাঠ ধরে আব্বুর পায়ের ওপর দাঁড়াতাম, হাতে জোর আসার পর হাত দিয়েই চলতো পা টেপার কাজ। আব্বুর পা আমরা দু ভাই টিপে দিয়েছি তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। শেষের কয়েক বছর নিজে থেকে বলতেন না, আমরা নিজে থেকেই তাঁর পায়ের কাছেই বসতাম। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে চলতো আমাদের হাত।
সাধারণভাবে, আমরা যখন স্কুলে যেতাম, আব্বু তখন ঘুমাচ্ছেন আবার রাতে আমরা যখন ঘুমাতে যেতাম, বাসায় ফেরার সময় তখনো হয়নি তাঁর। ছুটির দিনগুলোতে আব্বুর সাথে পায়া পরাটা খাওয়া তাই আমাদের খুব প্রিয় ছিলো। আব্বুকে কখনো আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে যেমন দেখিনি, তেমনি গায়ে হাত তুলতেও দেখিনি। পুরোপুরি রাজনীতিই ছিলো তাঁর ধ্যান জ্ঞান। সংসারটা তাই মা’ই সামলেছেন আজীবন। তবু যতোবার ঢাকায় যেতেন, তাঁর সেই ছোট্ট ব্রিফকেসের পকেটে থাকতো আমাদের জন্য দু প্যাকেট কাজুবাদাম, নইলে রঙিন কাগজে মোড়ানো দুটি আমসত্ত্বের প্যাকেট। কোনদিন এর অন্যথা হয়নি। শত কাজের ব্যস্ততার মাঝেও কোনদিন তাঁর সেই ব্রিফকেসের পকেট খালি থাকেনি, আমাদের হাত সেই পকেট থেকে কোনদিন পূর্ণ না হয়ে ফেরেনি।
আমি সেদিন কাস থ্রি তে ভর্তি পরীক্ষা দেবার জন্য ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজে গেছি। আমার সাথে একই শ্রেণিতে পরীক্ষা দিয়েছিলেন আমার বড় ভাই সোহান। আব্বু তখন এমপি। রেজাল্ট বের হবার পর দেখা গেল, ভাইয়া চান্স পেয়েছে কিন্তু আমি নই। আব্বু জানতে চাইলেন, কেন আমার ছেলে বাদ পড়লো ? প্রিন্সিপ্যাল স্যার জানালেন, আপনার ছেলের হার্টের সমস্যা আছে। আব্বু আমাকে ঢাকার সবচেয়ে বড় হার্ট স্পেশালিস্ট এর কাছে নিয়ে গেলেন। আমাকে ইনজেকশন দেয়া হবে শুনে আমার সে কী আকুল বিকুল কান্না। আব্বু বললেন, তুমি যদি ইনজেকশন দাও তবে সবচেয়ে ভালো জুতা তোমাকে কিনে দিবো। আমি সেদিন আসলেই অনেক দামি একটি জুতা কিনে এমপি হোস্টেলে ফিরেছিলাম। পরের দিন রিপোর্টে দেখা গেল, আমার হার্টে কোনো সমস্যা নেই। আব্বু প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে রিপোর্ট দেখালে উনি বললেন, আসলে একই পরিবারের দুই ভাইকে আমরা সাধারণত ভর্তি করি না। আমার তৎকালীন সংসদ সদস্য বাবা কিন্তু কোনো চাপ বা তদ্বির না করেই ফেরত এসেছিলেন।
আমাদের পড়াশুনা জীবনটা ছিলো অদ্ভুত। ড্রইংরুমে আমরা দু ভাই পড়তাম। সকাল হতে না হতেই গ্রাম থেকে অনেকে আসতেন আব্বুর সাথে দেখা করতে। তারা প্রথমে সোফায় বসতেন, তারপর পা লম্বা করে ঘুম দিতেন উচ্চস্বরে নাক ডাকতে ডাকতে। স্যার আমাদের ওই রুমেই পড়াতেন। সুতরাং স্যারের কাছে পড়া চলতো ওই নাক ডাকার ভেতরেই। কতদিন ঘুম ভেঙে চমকে উঠে দেখি আমাদের বিছানার চারপাশ জুড়ে কত মানুষ বসে আছে। রাজনীতিবিদ বাবার সন্তানদের জীবন এমনই। আমরা জানতামই না বেডরুম আর ড্রইংরুম বলে আলাদা কিছু আছে।
এ রকম একদিনের কথা খুব মনে পডছে। আমি ড্রইংরুমে পড়ছি। একটি ছেলে এসে বসলো সোফায়। কিছুক্ষণ পর আব্বু এসে তাকে দেখে প্রচন্ড রাগারাগি করলেন। ছেলেটি সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আমার খুব মন খারাপ হলো। হঠাৎ দেখলাম, আব্বু বেরিয়ে এসে ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে বলছেন, তোকে বলেছি প্রয়োজনে ১০ বার ডিসি সাহেবের কাছে যাবি, কিন্তু তুই একবার গিয়ে আমার কাছে রোজ আসিস। ওরে বুঝিস না কেন, তুই যদি ৫ বার উনার কাছে যাস, তাহলে আমি উনাকে বলতে পারবো, একটি ছেলে সামান্য একটা কাজের জন্য আপনার কাছে পাঁচবার এসেছে, আপনি কি পাথর দিয়ে তৈরি? মানুষের জন্য কাজ করবার নিয়্যতে সরকারি চাকরি করেন, আর সেই মানুষকেই অবহেলা করেন? আমার মনটা ভরে গেল, আমি বুঝলাম কাজ করিয়ে নিতে গেলে টেকনিক লাগে।
আব্বু প্রথম এমপি হবার পর (১৯৭৯ সালে) কয়েকটি দেশে সরকারি সফরে গিয়েছিলেন। প্রথম দেশ ছিলো চায়না। আমার জন্য সাইকেল কিনলেন সেখান থেকেই। এরপর সেই সাইকেল ঘাড়ে করে হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ভ্রমণ শেষে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। আমার এলাকার সমস্ত বন্ধু ওই সাইকেল নিয়েই জীবনে প্রথম সাইকেল চালানো শিখেছিলো। সাইকেল আমিও একবার কিনেছিলাম আমার মেয়ের জন্য চায়না থেকে। হংকং বর্ডার পার হতে গিয়ে অনুভব করেছিলাম কত কষ্ট করে তিঁনি সেদিন আমার স্বপ্নের ওই সাইকেল এনেছিলেন।
এরপর শুরু হয়েছিলো আমাদের কষ্টের দিন। দিনের পর দিন বারংবার কারাবরণ, মামলার পর মামলা ঘাড়ে নিয়েও আমার আদর্শবাদী বাবা লড়াই করে গেছেন। কোনো লোভ লালসা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি, শত নিপীড়ন তাঁকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। আর তাই, তথ্যমন্ত্রী হয়েও আমাদের পরিবার টিভি চ্যানেলের মালিক নয়, বন ও পরিবেশমন্ত্রী হয়েও বনের আশপাশে আমাদের কোনো জমি নেই, সমাজকল্যাণমন্ত্রী হয়েও আমরা কোনো এনজিও’র মালিক নই, খাদ্যমন্ত্রী হয়েও সরকারি খাদ্য সরবরাহের কোনো লাইসেন্স আমাদের নেই, ডাক ও টেলি যোগাযোগমন্ত্রী হবার পরেও নেই ওই সংক্রান্ত কোনো ব্যবসা।
একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। ১৯৯৮ সাল। আমার বিয়ে দিয়েছেন আব্বু ধুমধাম করে। যেহেতু বিয়েটা যশোরে হয়েছিলো, অনুষ্ঠানে উনি কোনো কার্পণ্য করেননি। ৫ হাজারের বেশি মানুষ নিমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। আমি তখন এনার্জিপ্যাক নামক একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। ছুটিও কম। তাই বিয়ের দু দিনের মাথায় সোহাগ পরিবহনের একটি বাসে করে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় ফিরছি। বাসে ওঠার পর থেকেই লক্ষ্য করলাম একজন ব্যক্তি বারবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন, যদিও আমি তাকে চিনি না। বাস ফেরিতে ওঠার পর উনি এসে জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা কি যশোরের? বললাম, জ্বী। উনি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি আতিয়ার রহমান, যশোর এম এম কলেজের শিক্ষক। তোমাদের পরিচয় জানতে পারি ? আমি আমার নাম বল্লাম। উনি জানতে চাইলেন, তুমি কি তরিকুল ইসলামের ছেলে যার দু দিন আগে বিয়ে হয়েছে? আমি উত্তরে হ্যাঁ বললাম। উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, সাবেক মন্ত্রীর ছেলে বিয়ে করে বউকে নিয়ে বাসে যাচ্ছে, বাবা আমার ভুল হয়ে গেছে, তোমার বাবার অনেক সমালোচনা আমি করেছি, শুনেছি তোমার বাবা মন্ত্রী হয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আজ তোমরা আমাকে অনুশোচনায় ভোগালে। আমি শুধু বলেছিলাম, আশা করি আপনার ভুল ভাঙবে।
এমনি অসংখ্য নিন্দুকের নিত্য মিথ্যাচার, অসত্য কথন তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিলো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। অথচ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এক আদর্শ নিয়ে তিনি রাজনীতি করে গেছেন শুধু মানুষের জন্য। সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, যশোরের উন্নয়ন, দেশের উন্নয়নই ছিলো তাঁর রাজনীতির ধ্যান জ্ঞান। সবার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিলো যেমন তীব্র নিজের প্রতি ছিলেন তেমনি উদাসীন। রাজনৈতিক নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত শরীর কে ঠিক রাখতে অনেক ওষুধ খেতে হতো তাঁকে। অথচ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একটি ওষুধের নামও তিঁনি জানতেন না। মা, আমরা দু ভাই আর আমাদের দু ভাইয়ের স্ত্রী তাঁর প্রতিবেলায় ওষুধগুলো গুছিয়ে দিতাম। জীবনের শেষ দু বছর ডায়ালাইসিস করতে হতো সপ্তাহে ৩ দিন। মা আর আমরা দু ভাই সব ছেড়ে দিয়ে শুধু তাঁর পাশেই থেকেছি। সেই সাত সকালে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ফিরতে ফিরতে প্রায়ই বিকেল হয়ে যেত। এই অসহনীয় শারীরিক অবস্থার মধ্যেও মামলা থেকে তাঁর রেহাই মেলেনি। সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দলবল সহকারে বায়তুল মোকাররম এলাকায় বোমা হামলার মামলায় জামিন নিতে হুইল চেয়ার বসে হাসপাতাল থেকে জামিন নিতে তাঁকে হাইকোর্ট ছুঁটতে হয়েছিল মৃত্যুর ১৮ দিন আগেও।
আব্বুর মহাপ্রয়াণের সময় আমার মেয়ের ঙ লেভেল পরীক্ষা চলছিলো। দাদার খুব আদরের ছিলো ও। পড়া বাদ দিয়ে হাসপাতালে গেছে দিনের পর দিন। দাফনের পরদিনও ওর পরীক্ষা ছিলো। ঠিক করা হলো, ওর মায়ের সাথে সকালের ফ্লাইটে ঢাকা গিয়ে বিকেলে ফেরত আসবে। এয়ারপোর্টে আমার মেয়ের হাতে খোলা বই আর চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে নীরব অশ্রু। আমি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে আসি। কিন্তু, এক মহিলার চোখ এড়ালো না বিষয়টা। তিনি বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলেন। আমরা জানালাম ওর দাদা মারা গেছেন এবং পরীক্ষা দিতে তাকে ঢাকা যেতে হচ্ছে। আমার মেয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, ‘বাবা, আমরা কি নিজেদের মতো করে একটু কাঁদতেও পারবো না, আমিতো চিৎকার করে কাঁদিনি কিন্তু বইয়ের ওপর যে আমি শুধু দাদাভাই এর ছবি দেখতে পাচ্ছিলাম।’ আমি বলেছিলাম, রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যদের অনেক কিছু সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হয়। আল্লাহপাকের রহমতে আমার মেয়ে ওই অবস্থায় পরীক্ষা দিয়েও সব সাবজেক্টে এ প্লাস আর এ পেয়েছিলো।
আমরা কৃতজ্ঞ, তুমি আমাদের দু ভাইকে জন্ম দিয়েছিলে। আমরা বাবাকে হারিয়েছি কিন্তু দেশ হারিয়েছে এক মহৎপ্রাণ, উদার, অসাম্প্রদায়িক, নির্লোভ, আদর্শবান ও জনবান্ধব রাজনীতিককে যার জন্য অনেক বছর অপেক্ষায় থাকতে হয়।
তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেছ দু বছর আগে, চুকিয়ে দিয়ে জীবনের সব লেনদেন। আমাদের আকাশ আছে কিন্তু সেখানে শুকতারা নেই। আমাদের চোখ আছে, সেটা শুধু আজ অশ্রু ধরে, আমাদের জীবন চলছে কিন্তু সেখানে শুধুই শূন্যতার বাস।
আজ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, তুমি আমার বাবাকে ক্ষমা করে দাও। পৃথিবীর সব বাবাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। এই পৃথিবীতে ভোগ করা শত নির্যাতন আর নিপীড়নের বিনিময়ে তাঁর কবরবাসকে তুমি শান্তিময় করে দাও। নবীজীর কবরের সাথে তাঁর কবরের সংযোগ স্থাপন করে দাও। জান্নাতের বাগানে তাঁকে স্থান দাও।
আমরা যে একমাত্র তোমারই ইবাদত করি, তোমাকেই সিজদা করি, আমাদের চাওয়ার জন্য আর কেউ নেই, যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এই এতিম দু ভাইকে তুমি ফিরিয়ে দিওনা, তোমার রহমতের পূর্ণ দরবার হতে কেউ যে খালি হাতে ফেরে না।