ডিএসসিসির ‘ডেঙ্গুবান্ধব’ সিদ্ধান্ত, কমছে মশককর্মী!

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়লেও মশা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত থাকা কর্মীর সংখ্যা কমাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। সংস্থার বিভিন্ন অঞ্চলের ওয়ার্ডে নিয়োজিত নির্দিষ্ট সংখ্যক কর্মী রেখে বাকিদের সচিব দফতরে বদলি করা হয়েছে। ডেঙ্গুর এই মৌসুমে কর্মী কমানোকে চরম অবহেলা হিসেবে দেখছেন কীটতত্ত্ববিদ ও নাগরিকরা। তারা বলছেন, যেখানে অর্ধেকের চেয়েও কম জনবল নিয়ে কাজ করছে সিটি করপোরেশন, সেখানে কর্মী কমানো কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। বিশেষ করে এই ডেঙ্গু মৌসুমে সিটি করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্তকে ডেঙ্গুবান্ধবই বলা যায়।
ডিএসসিসির স্বাস্থ্যবিভাগ সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে প্রতিটি ওয়ার্ডে ১৩ থেকে ১৮ জন করে কর্মী রয়েছে। এ থেকে ৩ থেকে ৭ জন করে কর্মী কমিয়ে তাদেরকে সচিব দফতরে বদলি করা হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে অফিস সহকারী হিসেবে পদায়ন করা হচ্ছে। গত ৩১ অক্টোবর সংস্থার অঞ্চল-২ থেকে ২৫ জন কর্মীকে সচিব দফতরে বদলি করা হয়। এই অঞ্চলের ১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ৪ জন, ২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ৩ জন, ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ৫ জন, ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ৫ জন, ৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ৩ জন এবং ১৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ৫ জন কর্মীকে বদলি করা হয়। এভাবে সংস্থার প্রতিটি অঞ্চল থেকে কর্মী কমানো হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৬৫২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ছাড়া পেয়েছেন ৬০৬ জন। এখনও ৪২ জন ভর্তি আছেন। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই ৪০ জন রোগী। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন আরও ৮ রোগী।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু সন্দেহে ৪টি মৃত্যুর তথ্য পাঠানো হলেও সংস্থাটি এ থেকে ২টি মত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করে ১টি মত্যু ডেঙ্গুতে হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫, মার্চে ২৭, এপ্রিলে ২৫, মে মাসে ১০, জুনে ২০, জুলাই মাসে ২৩, আগস্টে ৬৮, সেপ্টেম্বরে ৪৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। গত অক্টোবরে ১৬৩ আক্রান্ত হলেও চলতি মাসের প্রথম দুই দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ জন। আর ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ছিল এক লাখেরও বেশি। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৪৮ জন।
জানা গেছে, গত বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব প্রকট আকার ধারণ করার পর দুই সিটি করপোরেশনকে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে জনবল নিয়োগের অনুমতি দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। চলতি বছর সেই জনবল নিয়োগ করে সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি মশা নিধনে ব্যবহারের জন্য সিটি করপোরেশনকে সরাসরি ওষুধ আমদানির অনুমতি দেওয়া এবং বেশ কিছু যন্ত্রপাতিও আমদানি করা হয়।
জনবল কমানো প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার  বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশনের জনবলের ঘাটতি রয়েছে। একটি ওয়ার্ডের মশা নিয়ন্ত্রণে যে পরিমাণ জনবল থাকা দরকার তার অর্ধেকের চেয়ে কম নিয়ে কাজ করছে সিটি করপোরেশন। এ কারণে মশা নিয়ন্ত্রণ কষ্টকর হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, জনবল কম থাকার কারণে বড় ধরনের একটা প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা রাখা হয়েছে। সেই প্রকল্পে জনবল ও মেশিনারিজ চাওয়া হয়েছে। সেটি এখনও পাস হয়নি। যেহেতু এখানে জনবলের ঘাটতি আছে, তাই জনবল বাড়ানো প্রয়োজন। কমানো উচিত না।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, আমরা একেকটি ওয়ার্ডকে ৮ থেকে ১০টি সেক্টরে ভাগ করে প্রতি সেক্টরে কমপক্ষে ৪ জন করে জনবল রাখতে বলেছি। এক্ষেত্রে একটি সেক্টরে একজন লার্ভিসাইডিং, একজন অ্যাডাল্টিসাইডিং, একজন পরিস্থিতি কতটা উন্নতি বা অবনতি হয়েছে তা দেখভাল করবে এবং অন্যজন এলাকার নাগরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক বা যোগাযোগ রাখবে, যাতে তারাও মশক নিয়ন্ত্রণ কাজে যুক্ত থাকতে পারে। এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে মশার উৎপাদনস্থল থাকতে পারবে না। এতে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ৩২ থেকে ৪০ জন লোক লাগবে। কিন্তু সেখানে আছে এখন ১২ থেকে ১৩ জন লোক। এ থেকে আরও কমানো কাম্য হতে পারে না।
সিটি করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক নাগরিক। মগবাজার ডাক্তার গলির বাসিন্দা নাসির উদ্দিন  বলেন, গত বছর থেকে সিটি করপোরেশন শিক্ষা নিতে পারেনি। এতগুলো মানুষ মারা গেলো! এ বছর সেই কার্যক্রমকে যেখানে আরও জোরদার করার কথা, সেখানে জনবল কমানোকে দায়িত্বে অবহেলা ছাড়া আর কিছুই মনে করছি না।
সেগুনবাগিচার হেদায়েত হোসেন বলেন, সিটি করপোরেশনের কোনও কর্মীকেও দেখি না। সেখান থেকে যদি আরও কমানো হয় তাহলে তো মশার যন্ত্রণায় বাসায়ও থাকা যাবে না। আমার বিশ্বাস ডিএসসিসি এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির মশক নিধন কর্মসূচির নেতৃত্বদানকারী উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মীর মুস্তাফিজুর রহমান  বলেন, আমাদের নিয়মিত ফগিং কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পর এ কর্মসূচি আরও জোরদার করেছি। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। মেয়র মহোদয় এলে তার সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক হবে।
কর্মী কমানো প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের মেশিন কম, তাই কর্মী কমিয়েছি। এটা রিভিউ করা হতে পারে। প্রয়োজন হলে মেশিন যখন বাড়বে তখন তাদের আবার ফেরানো হবে।
এদিকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ায় ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার এক জরুরি সভা করেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সোমবার থেকে ডিএনসিসি এলাকায় ১০ দিনব্যাপী বিশেষ মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু হয়। অভিযানের প্রথম দিন ৯৪টি স্থাপনায় এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। এতে ৯টি মামলায় প্রায় তিন লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।