দর্শনা প্রাণী সংগনিরোধ কেন্দ্রের কার্যক্রম চালু হয়নি: ছয় অর্থবছরে সরকারের আয় প্রায় তিন কোটি টাকা, ঘুষ গ্রহণ সাড়ে ৫ কোটি

0

রিফাত রহমান, চুয়াডাঙ্গা ॥ চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রাণী সংগনিরোধ কেন্দ্রটির কার্যক্রম চালু না হওয়ায় তা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। জনবল সংকটে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রটিও গতি হারিয়েছে। ছয় অর্থবছরে এ কেন্দ্র থেকে সরকারের আয় হয়েছে ২ কোটি ৯৯ লাখ ৭৯ হাজার ৬২ টাকা। আর ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের রেলওয়াগানের ছাড়পত্র পেতে সিএন্ডএফ এজেন্টদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়া হয়েছে ৫ কোটি ৫৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে দর্শনা ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে ৬ শতক জমির ওপর প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে প্রাণী রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের আওতায় প্রাণিসম্পদ সংগনিরোধ কেন্দ্রটি নির্মিত হয়। এই কেন্দ্রটি নির্মাণের পর চুয়াডাঙ্গা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কাছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর করে ২০১৮ সালে। ভারত থেকে বৈধভাবে আসা প্রাণীর ওষুধ ও ভ্যাকসিন দেয়া এবং প্রাণী ৭ থেকে ১৪ দিন এই কেন্দ্রে রেখে রোগ নির্ণয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এই স্থাপনায় কোন কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ায় তা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। দিনে ও রাতে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া দুজন প্রহরী ভবনটি পাহারা দেন। এ দুজনের মধ্যে একজনের বাড়ি অন্য জেলায় হওয়ায় তিনি সার্বক্ষণিক ভবনেই অবস্থান করেন। আর অপরজনের বাড়ি ভবনের পাশে জয়নগর এলাকায় হওয়ায় তাকে বেশিরভাগ সময় ভবন পাহারায় থাকতে দেখা যায় না। সরেজমিনে দর্শনার জয়নগর ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে গিয়ে দেখা যায়, প্রাণী সংগনিরোধ কেন্দ্রটির কোন স্থানেই সাইনবোর্ড নেই। বৃষ্টির পানিতে ভবনের দেয়াল অন্য বর্ণ ধারণ করেছে। ওপরের কিছু অংশে বৃষ্টির পানি ঠেকাতে পলিথিন ব্যবহার করা হচ্ছে। দামুড়হুদা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মশিউর রহমান জানান, দেশের ২৫টি স্থানে ‘লাইভ স্টক কোয়ারেন্টাইন’ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। শুধুমাত্র ঢাকা বিমান বন্দর ও যশোরের বেনাপোলে কেন্দ্র চালু রয়েছে। প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে এলেও জনবল নিয়োগ না হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, সাতক্ষীরার ভোমরা ও বাগেরহাটের মোংলায় প্রাণী সংগনিরোধ কার্যক্রম চালু করা যায়নি। কেন্দ্রটি চালু করতে গেলে একজন সহকারী পরিচালক, একজন ভেটেরিনারি সার্জন, দুজন টেকনেশিয়ান, একজন অফিস সহায়ক ও একজন অফিস সহকারি প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, দর্শনা ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে নির্মিত প্রাণী সংগনিরোধ কেন্দ্রের নিচে অফিস কক্ষ, ল্যাবরেটরি, প্রাণী চিকিৎসাদি করানোর স্থান ও উপরে আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। জনবল নিয়োগ হলেই এই দপ্তরের কার্যক্রম চালু হয়ে যাবে। এই কেন্দ্রটির কোন স্থানেই সাইনবোর্ড না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যখন ভবনটি হস্তান্তর করে তখনই তারা কোন সাইনবোর্ড দিয়ে যায়নি। এখনও সেটা করা যায়নি। এদিকে জনবল সংকটের কারণে দর্শনার উদ্ভিদ সংনিরোধ কেন্দ্রটিও তেমন কাজে আসছে না। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে দর্শনা পৌরসভা ভবনের কোল ঘেঁসে ২৩ শতক জমির ওপর নির্মিত আধুনিক উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। সেই থেকেই এখানে জনবল সংকট। ‘বেশি কাজ নেই’ সে কারণে এই কেন্দ্রে কেউ বদলি হয়ে আসতে চান না বলে জানান। তবে সরকারি ফি বাবদ তহবিলে যা জমা হয় তার চেয়ে বেশি আয় এ কেন্দ্রের বর্তমান কর্মরতদের এমনই অভিযোগ করেছেন কয়েকজন সিএন্ডএফ এজেন্ট। হয়রানির ভয়ে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভারত থেকে তাদের আমদানি করা পণ্যের ছাড়পত্র পেতে রেলওয়াগন প্রতি দর্শনা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে ২ হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। টাকা না দিলে আমদানি পণ্যের ছাড়পত্র পেতে ভোগান্তির সীমা থাকে না। ঘুষের এই টাকা দিলেই রেলওয়াগানে কী আছে তা না দেখেই তারা ছাড়পত্র দিয়ে দেন। এতে ঝামেলামুক্ত হওয়া যায়।
একটি সূত্র জানায়, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি পণ্যের ৬ হাজার ৩১১টি রেলওয়াগন থেকে সরকার ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা আয় করে। যার ছাড়পত্র নিতে উৎকোচ দিতে হয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ ২২ হাজার। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ৯৭৩টি রেলওয়াগন থেকে আয় হয় ৫৮ লাখ ৮ হাজার ৫৪০ টাকা। এর বিপরীতে উৎকোচ দিতে হয়েছে ১৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৪ হাজার ৮৭৭টি রেলওয়াগন থেকে আয় হয় ২৮ লাখ ২৭ হাজার ১৫ টাকা, উৎকোচ দিতে হয়েছে ৯৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১০ হাজার ৬৫৯টি ওয়াগান থেকে আয় হয় ৯৮ লাখ ১৭ হাজার ৮৫৬ টাকা, উৎকোচ দিতে হয়েছে ২ কোটি ১৩ লাখ ১৮ হাজার টাকা। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৮৭টি ওয়াগন থেকে আয় হয় ৩৭ লাখ ১৮ হাজার ৯৯৯ টাকা, উৎকোচ দিতে হয় ৬৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৯৫৫টি ওয়াগন থেকে আয় হয় ৪১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৩৫ টাকা, উৎকোচ দিতে হয় ৩৯ লাখ ১০ হাজার টাকা। গত ছয়টি অর্থবছরে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে সরকারের মোট আয় হয়েছে ২ কোটি ৯৯ লাখ ৭৯ হাজার ৬২ টাকা। আর সিএন্ডএফ এজেন্টদের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে উৎকোচ দিতে হয়েছে ৫ কোটি ৫৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা। দর্শনা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সেখানে উদ্ভিদ সংগনিরোধ রোগতত্ত্ববিদ, স্টোরকিপার ও অফিস সহকারি নেই। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে প্রেষনে দর্শনা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে কর্মরত উপ-সহকারি সংগনিরোধ কর্মকর্তা, উদ্ভিদ পর্যবেক্ষক, অফিস সহায়ক, অফিস গার্ড, ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা ও মেহেরপুর জেলার গাংনি উপজেলা কৃষি অফিস থেকে দুজন ঝাড়–দার প্রেষনে এই দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছেন। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে প্রেষনে দর্শনা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে কর্মরত উপ-সহকারি সংগনিরোধ কর্মকর্তা সেলিনুর রহমান জানান, গোটা সংগনিরোধের কার্যক্রম তিনিই চালাচ্ছেন। তিনি নিজেই পণ্য পরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেন। ১৯৯১-১৯৯২ অর্থ বছর থেকে দর্শনায় সংগনিরোধ কেন্দ্রটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়। প্রকার ভেদে সরকারি ফি জমা নিয়ে এখান থেকে মূলত কৃষি দ্রব্যাদি আমদানি-রফতানির অনুমতিপত্র দেয়া হয়। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল দর্শনা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে অতিরিক্ত উপ-পরিচালক হিসেবে কামরুন নাহার যোগদান করেন। তিনি ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর এ বছরের ১৮ মে দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে ওই পদে যোগদান করেন। এরপর দাপ্তরিক কাজে কিছুটা গতি ফেরে। দর্শনা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মনিরুজ্জামান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) বলেন, এ দপ্তরে জনবল সংকটের কারণে দাপ্তরিক কার্যক্রম চালাতে খুবই সমস্যা হচ্ছে। করনাকালীন সময়ে ভারত থেকে পণ্যবাহী ট্রেন কম আসছে। যে কারণে কাজের চাপ বেশি নেই। আমদানিকৃত পণ্যবাহী রেলওয়াগান প্রতি ২ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন না বলে জানান।