আইনের নির্দয়তা ও বাস্তবায়নের ব্যবধান ঘুচাতে হবে

0
প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
সম্প্রতি দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে ‘ঢাবি শিক্ষার্থী খুনের বিচার শেষ হয়নি ৪৩ বছরেও’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালের ওই খুনের বিচারে এ পর্যন্ত যুক্ত হয়েছেন ৩৪ জন বিচারক। মামলাটি এ পর্যন্ত পাঁচটি আদালত ঘুরেছে। কেন এই বিলম্ব? আদালতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের পর বছর পার হলেও পুলিশ নাকি বাদি, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারছে না। পুলিশ বলছে, তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবেই চলছে। এখন পত্রিকায় প্রকাশের কারণে বিভিন্ন মহলের নজর এসেছে। এর পরও কবে এই বিচার শেষ হবে তা কেউ জানে না। ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’ বহু পুরনো প্রবাদ। আবার এ কথাও বলা হয় যে ‘টু ডিলে জাস্টিস ইজ ইনজাস্টিস’। দেশে সম্প্রতি ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ফলাও করে এই সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। এ ধরনের অপরাধ সমাজের অবনতিশীল অবস্থা প্রকাশ করে। আরো অনেক অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। গুরুতর অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে ইসলামেও। সৌদি আরবে আমি দেখেছি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের প্রতি শুক্রবার শিরñেদ করতে। পশ্চিমা মিডিয়া ইসলামিক আইনের এই প্রয়োগকে খুবই নিষ্ঠুর বলে সমালোচনা করে। কিন্তু ওরা যে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে তিলে তিলে হত্যা করে, সেটি কী? সেটি তো আরো বেশি নিষ্ঠুর। আমেরিকার বহু অঙ্গরাজ্যে এখনো মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। আছে ইউরোপের অনেক দেশেও। আসলে আইনের কঠিনতা বা নির্দয়তার (severity of law) সাথে প্রয়োগের সম্পর্ক নিবিড়। আমার সুযোগ হয়েছে বহু দেশের আইন ও আইনের প্রয়োগ দেখার। অ্যাকাডেমিক আলোচনায় আইন প্রয়োগের মাত্রা নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু আমাদের এখানে আইনের প্রয়োগ খুব কম। নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড দিলে সবাই খুশি হলো। পত্রিকায় বড় বড় হেডলাইন হলো। কিন্তু আমাদের আইনেই আছে এই দণ্ড উচ্চ আদালত নিশ্চিত করতে হবে। এমন নজিরও আছে যে নিম্ন আদালতের বিচারক আবেগের বশে রায় দিয়ে দিলেন যে ‘গুলি করে’ মারো। কিন্তু এ ধরনের দণ্ড কয়টি শেষ পর্যন্ত বহাল থাকছে সেই খবর কয়জন রাখে। আমাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এ বিষয়টি তেমন উঠে আসছে না।
আমার এ কথা বলার কারণ, দীর্ঘ দিন বিদেশে কাটিয়ে আমি দেশে এসেছি ২২-২৩ বছর হয়ে গেছে। একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে এই প্রায় দুই যুগ দেশের সমাজকে স্টাডি করার চেষ্টা করেছি। আমি যখন দেশ ছেড়ে যাই তখন যে সমাজ ছিল দেশে ফিরে সম্পূর্ণ নতুন সমাজ দেখি। আমিও একসময় সামান্য ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। আমি বেশ কিছু মৃত্যুদণ্ড স্টাডি করে দেখেছি। মৃত্যুদণ্ডের মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে যেত ১০-১২ বছর লেগে যায়। সুপ্রিম কোর্ট দণ্ড বহাল রাখলে তার বিরুদ্ধেও আপিলের সুযোগ রয়েছে। আবার অনেক আসামি তো রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তিও পেয়ে গেছেন। এটি রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। কিন্তু সব মিলিয়ে আমাদের বিচারব্যবস্থাটি আমার কাছে প্রহসন বলে মনে হয়েছে। আইনের কঠিনতা ও আইনের বাস্তবায়নে এত ব্যবধান যে তখন বিচারটি আর বিচার থাকে না। উপরের প্রবাদ অনুযায়ী ‘অবিচারে’ পরিণত হয়। দণ্ড দেয়া হলো কিন্তু সেটা নিশ্চিত করতে যদি যুগ পেরিয়ে যায় তখন আর ওই দণ্ডের বিষয়টি কেউ মনে রাখে না। এসব মামলার বিচার কোনো স্বাভাবিক আদালতে নয়, সামরিক আদালতের মতো বিশেষ কোনো আদালতে করা উচিত। বিচার হবে সংক্ষিপ্ত এবং রায় কার্যকর হবে তৎক্ষণাৎ। আমাদের এখানে দ্রুত বিচার আদালতও আছে। কিন্তু এর রায় কি দ্রুত কার্যকর হয়? সেটাও হয় না। হ্যাঁ, বিবাদিকে আপিল করার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু সেই আপিলও সাত দিনের মধ্যে বা যত সম্ভব দ্রুত নিষ্পত্তির বিধান থাকতে হবে। এটা না থাকাই আজকে এখানে সামাজিক ব্যাধি গুরুতর আকার ধারণ করার কারণ। দণ্ডদান ও প্রয়োগের মধ্যে ব্যবধানটি ঘুচানোর কথা উচ্চারিত হয় সামান্যই।
ব্রিটিশরা বিদায় নিয়েছে সাত দশকের বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের বিচারব্যবস্থা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্তি পায়নি। ব্রিটিশরা আইন করেছিল শোষণ করার জন্য। সেই শোষণ থেকে মুক্তি পেতে দেশ স্বাধীন করে জনগণের লাভ হলো কোথায়? আমাদের আদালতগুলোতে মামলার পাহাড় জমে আছে। কিন্তু এই পাহাড় কেটে সমতল করার কথা বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভাবলেও সেই ভাবনার প্রতিফলন আমরা দেখি না। আমি সরকারি চাকরিতে যোগদানের পর যে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাই তা সর্বনিম্ন বিচারিক ক্ষমতা। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে ময়মনসিংহ সদরে আমার প্রথম পোস্টিং হয়। আমার এখতিয়ারে যে আদালত ছিল তার ক্ষমতা ছিল ‘তৃতীয় শ্রেণীর’। সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শ্বশুর উমেদ আলী তখন ময়মনসিংহ আদালতে প্র্যাকটিস করতেন। তিনি সিরাজগঞ্জের সাবডিভিশন অফিসার ছিলেন। তাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। তিনি সিনিয়র উকিল ছিলেন। বড় বড় মামলা নিতেন। সে সময় আমার কাছে একটি মামলা আসে। এর আসামি হচ্ছেন এক বৃদ্ধ চাচা, আর বাদি হচ্ছেন তার কয়েকজন ভাতিজা। উমেদ আলী বাদিপক্ষের উকিল। দেখি তিনি মামলায় বেশ জোরালো যুক্তিতর্ক পেশ করছেন। আসামির বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ। সাক্ষ্য-প্রমাণ যা ছিল, তা দেখে আমার মনে হচ্ছিল, চাচার সাজা হতে যাচ্ছে। কিন্তু চাচাকে দেখার পর আমার মনে হলো, আর যাই হোক এ লোক চুরি করতে পারে না। এটা হলো ‘নেগেটিভ হ্যালো’ ও ‘পজিটিভ হ্যালো’ বলে মনোবিজ্ঞানে দু’টি পরিভাষা আছে। কাউকে একনজর দেখেই তোমার মনে হতে পারে লোকটি ভালো। আবার উল্টাও মনে হতে পারে। এজলাসে সাক্ষ্য গ্রহণ সে দিনের মতো বন্ধ রেখে আমি পেশকার দিয়ে চাচাকে ডেকে এনে জানতে চাই, কেন ভাতিজারা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তিনি বললেন, তার কোনো সন্তান নেই। মামলাকারীরা তার বাগানে ঢুকে আম-কাঁঠাল সব পেড়ে নিয়ে যায়, নানাভাবে যন্ত্রণা দেয়। এ নিয়ে তাদের বকাবকি করেছেন, তাদের মা-বাবার কাছে নালিশ করেছেন। তাই তারা মিলে এ মামলা করেছে। পরে ভাতিজাদের ডেকে কথা বলি, তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। তারা মামলা তুলে নিতে রাজি হয়। এভাবে প্রথাগত নিয়মের বাইরে গিয়ে প্রচুর মামলা নিষ্পত্তি করেছি।
পুলিশ কিভাবে হয়রানি করে তার একটি ঘটনা বলি। কোর্ট দারোগা থাকে। তাদের কাজ হলো বাদি বা আসামিকে হাজির করা। একবার একটি মামলায় দেখি কোর্ট দারোগা প্রায়ই বলছে যে বাদি আসেনি। যে আসামি সে অনেক দূর থেকে প্রতিদিন এসে হাজির হচ্ছে। কিন্তু বাদি না থাকায় মামলা আর এগোয় না। আমি যখন নিশ্চিত হলাম যে কোর্ট দারোগা ইচ্ছা করে এটা করছে তখন তাকে ডাকলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি কেন সে এই লোকটিকে হয়রানি করছে। তুমি নানা বাহানায় বাদিকে হাজির করছ না কেন? তখন আমি তাকে আদালত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার দণ্ড দিলাম। ম্যাজিস্ট্রেটের এই ক্ষমতা এখনো আছে। কিন্তু আমাদের বিচারকরা এভাবে কতটা ভাবেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে লেখার প্রথমে উল্লিখিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। তখন আখতার হামিদ খানের মতো ব্যক্তিরা প্রথার বাইরে গিয়ে অনেক বিচার করে সুনাম কুড়িয়েছেন। একবার অভিযোগ এলো এক ছেলে হয়তো মাকে খেতে দেয় না। তিনি ওই ছেলেটিকে ধরে এনে গাছের সঙ্গে বেঁধে গায়ে পিঁপড়া ছেড়ে দিলেন। পিঁপড়ার কামড় খেয়ে যখন সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল তখন বললেন তুমি এই পিঁপড়ার কামড় খেয়ে কান্নাকাটি করছ, আর তোমার মা ৯ মাস তোমাকে পেটে ধরেছে, সেই মায়ের সাথে এমন আচরণ, আর করবে কি না বলো? তার এই প্রথার বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের লাঘবের চেষ্টা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তার সঙ্গে আমার দেশে-বিদেশে কাজ করারও সুযোগ হয়েছে। সমাজের যে মানুষগুলো বিচার না পেয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে তাদের দুর্ভোগ লাঘব করার দায়িত্ব কেউ নিতে চাচ্ছে না। আমি যেসব উদাহরণ তুলে ধরলাম তেমন ঘটনা আজকের সমাজে বিরল। আমি যখন এভাবে বিচারকার্য করা শুরু করি তখন এক বছরেরও কম সময়ে (তত দিনে আমি সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে ইসলামাবাদ চলে যাই) দেখি আমার টেবিলে মামলার ফাইল অর্ধেক হয়ে গেছে। এতে উকিলরা ক্ষেপে ওঠে। তখন ময়মনসিংহের ডিসি ছিলেন পিএ নাজির (পিয়ার আলী নাজির), বেশ জাঁদরেল ও নামকরা ডিসি। আমি তাকে গিয়ে আমার কাজের বিষয়ে অবহিত করি। তিনি উৎসাহ দিয়ে বলেন, বেশ ভালো করেছ। তিনি থাকাকালে এক দিন আমি অফিসে কাজ করছিলাম। হঠাৎ জানতে পারি, এক প্রকৌশলীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মারধর করেছে, তার বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে। ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারলাম ওই প্রকৌশলীর বাবা একজন দরিদ্র কৃষক। তিনি অনেক কষ্ট করে ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পর ছেলে আর মা-বাবার সাথে যোগাযোগ রাখেন না বা তাদের দেখাশোনা করেন না। ঘটনার দিন বাবা গ্রামের বাড়ি থেকে এক টিন মুড়ি নিয়ে ছেলের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। ইঞ্জিনিয়ার ছেলে তখন তার বন্ধুদের সাথে বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। বাবার ভালো পোশাক ছিল না। ছেলের বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে, তিনি কে? বাবার সামনে ছেলে বলেছে, আমার বাসার কামলা। এটা শুনে বাবা খুবই মনঃক্ষুন্ন হন। তিনি সবার সামনে ছেলেকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমি কে, তা তোর মাকে জিজ্ঞাসা করিস।’ এরপর তিনি ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। আইয়ুব খানের আমলে তখন গুজব ছিল ভারতের টিকটিকিরা (গোয়েন্দা) বিভিন্ন স্থানে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এলাকার কিছু অতি উৎসাহী ছেলে বৃদ্ধ লোকটিকে উদ্ভ্রান্তের মতো ক্যাম্পাসে ঘুরাফেরা করতে দেখে টিকটিকি মনে করে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে।
বাবা সব কিছু খুলে বললে উত্তেজিত ছেলেরা ওই ইঞ্জিনিয়ারকে বাড়ি থেকে ধরে এনে মারধর করে। ফলে ইঞ্জিনিয়ার মামলা করে। ছাত্রদের দলটির মধ্যে আমার এক ভাই ছিল। সে আমাকে আসল ঘটনা খুলে বলে। আমি বুঝলাম ইঞ্জিনিয়ার অন্যায় করেছে। তাই বলে ছাত্ররা তো আর আইন হাতে তুলে নিতে পারে না। এটি ফৌজদারি অপরাধ। তখন আমি ইঞ্জিনিয়ারকে ডেকে বিষয়টি বুঝালাম। বাবার সাথে এমন কাজ করা যে ঠিক হয়নি সে স্বীকার করল। তাকে বলি, আমি রিপোর্টে ছাত্রদের পক্ষে কিছু লিখব না, আপনি এটা নিয়ে আর হইচই করবেন না। তিনি মেনে নিলেন। ছাত্রদের ডেকে বুঝালাম আইন হাতে তুলে নেয়া ঠিক হয়নি। তারাও তা মেনে নিলো। আমি দু’পক্ষকে মিলিয়ে দিলাম। এটা আমার কাজ ছিল না। কিন্তু কোনো ম্যাজিস্ট্রেট যখন সৎ সালিসকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন মানুষ তার রায়ই মেনে নেয়। সাধারণভাবে মানুষ ততটা খারাপ নয়। আমি এসে ডিসিকে সব বললাম। তিনি বললেন, খুব ভালো করেছেন। ডিসি তিন মাসের মাথায় আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্ষমতা দিতে সুপারিশ করলেন। প্রায় এক বছরের মাথায় যখন প্রথম শ্রেণীর ক্ষমতা পেলাম তার পরই ওই চাকরি ছেড়ে সুপিরিয়র সার্ভিসে চলে যাই। বিচারক হিসেবে বেশি দিন কাজ করার সুযোগ পাইনি। তবে আমার মনে হয়েছে, লিখিত নিয়মের ভেতরে থেকে সবসময় ন্যায়বিচার করা সম্ভব হয় না। ন্যায়বিচার করতে হলে কখনো কখনো নিয়মের বাইরে যাওয়াটাও জরুরি। আইন গণিতশাস্ত্র নয়, তাই ধরাবাঁধা সূত্র মেনে চলে না। সেখানে ক্ষেত্রমতো বাঁকা করার সুযোগ থাকাও দরকার। আমি যে কাজগুলো করেছি তা আদালতের সহজাত ক্ষমতা (inherent power of the court) বলে; সরল বিশ্বাসে বা অভিপ্রায়ে (bona fide intention), গরল বিশ্বাসে বা অশুভ উদ্দেশে (mala fide intention) নয়। আমাকে এ কাজ করতে কেউ বলেনি কিন্তু বলা হয়েছে ন্যায়বিচার করতে। আমি সহজাত ক্ষমতা ব্যবহার করেছি। আইনে এটা সুস্পষ্টভাবে লেখা থাকে না কিন্তু অন্তর্নিহিত চেতনা হিসেবে বিরাজ করে। আমাদের আইনজীবীরা শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করলে অনেক কিছু করতে পারেন। আরেকটি বিষয় হলো মানুষের কিন্তু একটি নীতিবোধ আছে। তুমি সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকলে তার সুফল পাবেই। মানুষকে আমরা বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী বলি। কিন্তু আমরা যে মারামারি করি সেটা কিন্তু পশুর আচরণ। পশুরা প্রকৃতির আজ্ঞাবহ। মানুষ কিন্তু তা নয়। এটাই মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য। আমরা দেখি পশুর আচরণ নিরূপণ করে দিচ্ছে প্রকৃতি। মানুষের ব্যাপারে সেটা সত্য নয়। মানুষ যদি বিচারবুদ্ধি পরিহার করে তাহলে সে কিন্তু পশুর আচরণ করবে।
আমাদের আইনে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। এগুলো দূর করার যথাযথ উদ্যোগ আমরা নিতে পারিনি। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ব্রিটিশ আইন অনুসরণ করলেও সেটা স্বীয়করণ বা আত্তীকরণ করতে পারিনি। সেখানেই আমাদের দুর্বলতা। সব না হলেও কিছু আইন হালনাগাদ করা হয়েছে কিন্তু সেটা স্বাধীনতার কয়েক দশক পরে। আসলে আমরা স্থবির হয়ে পড়েছি। আমাদের দৈন্যতা হলো চিন্তার দৈন্যতা। জুডিশিয়াল রিভিউ বলে একটি পরিভাষা আছে। বিচারপতিরা আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারেন। ইসলামেও কিন্তু এটা আছে। আমরা যাকে ইজতেহাদ বলি। কুরআন বা হাদিসে কিছু কোনো বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তখন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন ইসলামিক পণ্ডিতরা ইজতিহাদ করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন। তারা দেখেন সিদ্ধান্তটি আইনের চেতনার পরিপন্থী কি না। আমাদের বিচারকদের এ দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। কেউ খারাপ হলে আইন বদল করলেই সে ভালো হয়ে যাবে না। নৈতিক ভিত্তি জোরদার না করে শুধু আইন কঠিন করলে অপরাধ দূর হবে না। মানুষের মন থেকে যখন জবাবদিহিতার অনুভূতি চলে যায় তখন সে সহজেই অপরাধ করতে পারে। এই জবাবদিহিতা পার্থিব বা পারলৌকিক- দু’ক্ষেত্রেই। যথাযথ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মনে এই চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের সন্তানদের কার্যকর নৈতিক শিক্ষা দিতে পারলেই আজকের সমাজ নৈতিক অবক্ষয়ের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]