‘বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধর্ষক যেন পার না পায়’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ মধ্যরাতে মশাল হাতে একদল নারীর স্লোগানে স্লোগানে উত্তপ্ত রাজপথ। স্লোগানে আছে ধর্ষণহীন রাষ্ট্রের দাবি। আছে নিপীড়কের শাস্তির দাবি। আরও আছে ক্ষোভ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের হুঙ্কার। মঙ্গলবার (১৩ অক্টোবর) মধ্যরাতে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ ব্যানারে মশাল নিয়ে পদযাত্রা শুরু করেন বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ নানা পেশা ও বয়সের নারীরা।
মশাল ও পোস্টার হাতে এ সময় তারা ‘পুরুষের ক্ষমতা ভেঙে হোক সমতা’, ‘দিনে হোক রাতে হোক সামলিয়ে রাখো চোখ’, ‘নারী থেকে নারীতে বিদ্রোহ ছুঁয়ে যাক’, ‘আমি নির্দোষ আমি নারী, আসল দোষী ধর্ষণকারী’, ‘শোক নয় শক্তি তবেই হবে মুক্তি’, ‘ধর্ষকের কালো হাত ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও’, ‘আর কত অনাচার হাত ভেঙে দাও তার’, ‘প্রীতিলতার বাংলায় ধর্ষণের ঠাঁই নাই’, ‘ইলা মিত্রের বাংলায় ধর্ষকের ঠাঁই নাই’, ‘ফুলে নয় গানে নয় বিদ্রোহে কাটবে ভয়’, ‘বিলাপে না হলে হবে তা বিদ্রোহে’, ‘গলা ছেড়ে গাও গান পুরুষতন্ত্র হবে খানখান’, ‘ধর্ষণহীন রাষ্ট্র চাই, নিপীড়কের শাস্তি চাই’ ইত্যাদি স্লোগানে এগিয়ে যেতে থাকেন।
মধ্যরাতে পদযাত্রার কারণ উল্লেখ করে আয়োজকরা জানান, যখন একটি মামলা হয় অথবা অভিযোগ আসে তখন চায়ের দোকান থেকে শুরু করে শিল্পপতির বাসা পর্যন্ত কেউ ধর্ষকের পরিচয় নিয়ে কথা বলে না। আলাপ হয় নারীর পোশাক নিয়ে। প্রত্যেকটি জায়গায় মেয়েটির রাতে বাইরে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। আমরা নারী, শুধু এই কারণে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের যে চলাফেরার অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার খর্ব হবে, তা হতে পারে না। এই অধিকার সুরক্ষা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। আজকে নারী বলে আমি ঘর থেকে বের হতে পারবো না, এটা আসলে কোনও স্বাধীন দেশের পরিচয় নয়। আজকে এতগুলো নারী একত্রিত হয়েছে, কারণ তারা বিশ্বাস করে নারীর সুরক্ষা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারছে না। তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। প্রত্যেক জায়গায় সমঅধিকার, স্বাধীন রাষ্ট্রে চলাফেরার অধিকার আমরা চাই। রাত ১২টায় একজন নারীর প্রয়োজন হতে পারে হাসপাতালে যাওয়ার, তার কর্মস্থল থেকে ফিরে আসার। কিন্তু রাত ১২টা থেকে সকাল পর্যন্ত নারীর নিরাপত্তা যদি দিতে না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে দোষ নারীর পোশাকের নয়। দোষ সমাজব্যবস্থার, রাষ্ট্রব্যবস্থার। নারীর চলাফেরায়, স্বাধীনতায় ট্যাবু লাগানোর যে একটা ব্যাপার, আমাদের আটকিয়ে রাখার যে বিষয়, তার বিরুদ্ধে এবং তার প্রতিবাদেই আমরা আজকে রাত ১২টায় রাস্তায় নেমেছি।
রাত ১২টায় শুরু হওয়া পদযাত্রাটি শাহবাগ থেকে শুরু হয়ে এলিফ্যান্ট রোড হয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি, সিটি কলেজের সামনে দিয়ে কলাবাগান হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গিয়ে শেষ হয়। এরপর তারা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বসে সমাবেশ করেন। সমাবেশে ১২ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো:
১. সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণ-যৌন সহিংসতার সঙ্গে যুক্তদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক ও ন্যায্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনে ও সামাজিকভাবে ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন করতে হবে।
৩. পাহাড় ও সমতলের সব নারীর ওপর সব ধরনের যৌন এবং সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।
৪. জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লৈঙ্গিক পরিচয় নির্বিশেষে যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে যেকোনোভাবেই ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ (দোষারোপ করা/নিন্দা জানানো) বন্ধ করতে হবে। গ্রামীণ সালিশ/পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
৫. প্রাথমিক লেভেল থেকেই পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা (গুড টাচ ব্যাড টাচের শিক্ষা, সম্মতি বা কন্সেন্ট এর গুরুত্ব, প্রাইভেট পার্টস সম্পর্কে অবহিত করা) যোগ করতে হবে।
৬. ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন-১৮৭২ এর ১৫৫(৪) ধারা বিলোপ করতে হবে এবং মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।
৭. হাইকোর্টের নির্দেশানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতনবিরোধী সেল কার্যকর ও পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। সিডো সনদে বাংলাদেশকে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে।
৮. মাদ্রাসার শিশুসহ সব শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কোনও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হলে ৯০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৯. জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তকে নারী অবমাননাকর বার্তা প্রকাশ ও প্রচার করা নিষিদ্ধ করতে হবে।
১০. রাস্তাঘাটে নারীদের অযথা পুলিশি ও অন্যান্য হয়রানি বন্ধ করতে হবে। গণপরিবহনে নারীদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে।
১১. ধর্মীয় বক্তব্যের নামে অনলাইনে ও অফলাইনে নারী অবমাননাকর বক্তব্য প্রচার বন্ধ করতে হবে।
১২. যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে প্রান্তিক অঞ্চলের নারীদের সুবিধার্তে হটলাইনের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
পদযাত্রায় অংশ নেওয়া নুসরাত নামে একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘নারী হওয়ার কারণে প্রত্যেকটি জায়গায় আমাদের দিনের পর দিন কটু কথা শুনতে হয়। বিভিন্ন নির্যাতন, নিপীড়নের শিকারসহ যৌন হয়রানি সহ্য করতে হয়। আমরা বিশ্বাস করি, নারী হওয়া আমাদের দুর্বলতা নয়। এটিকে দুর্বলতা মনে করে কেউ আমাদের অপমান করতে পারে না, হয়রানি করতে পারে না।’ সমাবেশে বক্তারা আরও বলেন, দেশে এখন কী পরিমাণ ধর্ষণ বেড়েছে। রাষ্ট্র ধর্ষকের বিচার সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে পারছে না। তনু হত্যার ঘটনার কয়েকবছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আমরা বিচার দেখিনি। এই যে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, এটি ধর্ষককে আরও প্রণোদনা দেয়। কোনোভাবেই বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে একজন ধর্ষকও পার পেয়ে যেতে পারবে না।