শ্যামনগরে শিক্ষক নেতাদের সহযোগিতায় শিক্ষা অফিসারদের কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য

0

শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) সংবাদদাতা ॥ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার (প্রাথমিক) শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদের ৫ নেতার সহযোগিতায় শিক্ষা অফিসাররা ১২টি প্রকল্প থেকে কোটি টাকা ঘুষবাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, শ্যামনগর উপজেলায় ১৯১ টি বিদ্যালয় আছে। শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসব বিদ্যালয়ে উন্নয়ন খাতে ১১ টি প্রকল্পে বরাদ্দ আসে ৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্লিপ খাতে ১৫১ টি বিদ্যালয়ে বরাদ্দ ছিলো ৯৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। যার মোট বরাদ্দ ৪ কোটি ৯১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলনের আহবানে শিক্ষা অফিসে চলতি বছরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এক আলোচনা সভা হয়। ওই সভায় সহকারী চার শিক্ষা অফিসার যথাক্রমে মো. শাহ্ আলম, আজহারুল ইসলাম, সোহাগ হোসেন ও সোহাগ আলম এবং শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের পাঁচ নেতাসহ ১২ টি ইউনিয়ন শিক্ষক সচিব উপস্থিত ছিলেন। আরো উপস্থিত ছিলেন, শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল্যাহ আল মামুনসহ শিক্ষক নেতারা। এ সময় শিক্ষা অফিসার উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিস ও উপজেলার প্রকৌশলী (এলজিইডি) অফিসের খরচের বিষয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে সভায় উপস্থিত শিক্ষক নেতাদের সম্মতিক্রমে বরাদ্দকৃত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে স্লিপ খাতে ২ হাজার টাকা ও অন্যান্য খাত অনুযায়ী ১০% থেকে ১৫% এমনকি ২৬% হারে নগদ টাকা তোলার বিষয়টি সভায় গৃহীত হয়। সেই অনুযায়ী শিক্ষা কর্মকর্তারা কৌশলে শিক্ষা অধিদপ্তরের বরাদ্দকৃত টাকা থেকে ঘুষ আদায়ের জন্য ১২টি ইউনিয়ন থেকে পছন্দমতো ১২ জন প্রধান শিক্ষক (সচিব) নির্বাচন করেন। অভিযোগ আছে, শিক্ষা অফিসাররা কথিত ১২ জন শিক্ষকদের বদলির ভয় দেখিয়ে সচিব পদ সৃষ্টি করে তাদের মাধ্যমে স্ব স্ব বরাদ্দকৃত বিদ্যালয় থেকে কোটি টাকা ঘুষ আদায় করেছেন।
প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদের কথিত ওই পাঁচ নেতা হলেন-আটুলিয়া আদর্শ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি দীনেশ চন্দ্র মন্ডল, দনি ছোট কুপট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক ও প্রাথমিক শিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম (হেলাল), শিশু শিক্ষা নিকেতন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদের সভাপতি পরিমল কর্মকার, গাবুরা খোলপেটুয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেলওয়ার হোসেন এবং ফুলবাড়ি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি গনেশ চন্দ্র সাহা।
উল্লেখিত পদে থাকা প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন সৃষ্টিকৃত সচিব পদ মর্যাদা নিয়ে শিক্ষা অফিসারদের হয়ে প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করেছেন। এদিকে রীতিমত শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম হেলালের মাধ্যমে শিক্ষা অফিসারদেরকে দেওয়ার জন্য ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে দাবি করেন পূর্ব রমজাননগর স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সবুর। শিক্ষা অফিসারদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদ নেতাদের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে খ্যাগড়াদানা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল্যাহ আল মামুন, ধুমঘাট এস এম সি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র মন্ডল, হায়বাতপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান (লাভলু), পশ্চিম শ্রীফলকাটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হোসেন আলী, মাহমুদপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাহতাব উদ্দীনসহ অন্য প্রধান শিক্ষকরা বলেন, শিক্ষা অফিসারদের কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা পরিষদের নেতাদের অবহিত করলে অজ্ঞাত কারণে তারা নীরব ছিলেন। শিক্ষা অধিদপ্তর হতে আসা বরাদ্দের টাকা শিক্ষা অফিস থেকে ছাড় করার পূর্বে শিক্ষা অফিসারের ডাকে শিক্ষা অফিসে আলোচনা সভা হয়। সভায় ১২ জন সচিবের উপস্থিতিতে শিক্ষক সমিতির নেতা দীনেশ চন্দ্র মন্ডল, সিরাজুল ইসলাম হেলাল ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ নেতা পরিমল কর্মকার, দেলওয়ার হোসেন ও গনেশ চন্দ্র সাহা বরাদ্দের বিপরীতে স্লিপ খাতে ২ হাজার টাকা ও অন্যান্য খাত অনুযায়ী ১০% থেকে ১৫% এমনকি ২৬% হারে টাকা তোলার বিষয়ে সম্মতি প্রদান করেন। তারা আরো বলেন, অঘোষিতভাবে নেতা হওয়া ও দুর্নীতি করার জন্য পরিমল কর্মকার মনগড়াভাবে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদ নামীয় একটি সংগঠন শিক্ষক সমিতির বিপরীতে দাঁড় করিয়েছেন। আর এ কারণে শিক্ষক নেতাদের সহযোগিতা ও উস্কানিতে শিক্ষা অফিসাররা কোটি টাকা ঘুষবাণিজ্য করার সুযোগ পেয়েছেন।
এ ঘটনায় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেন, শিক্ষা অফিসার হিসাব রক্ষণ অফিস ও প্রকৌশলী (এলজিইডি ) অফিসের খরচের টাকা যোগান দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন। শিক্ষা অফিসারের বরাত দিয়ে তারা বলেন, শ্যামনগরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বরাদ্দ সীমিত হওয়ায় টাকা তোলা আবশ্যক। সে কারণে টাকা তোলার বিষয়ে আমরা সম্মতি প্রদান করি। এদিকে অঘোষিত বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক পরিষদের সভাপতি পরিমল কর্মকার ও সাধারণ সম্পাদক দেলওয়ার হোসেন বলেন, জুনের প্রথম সপ্তাহে শিক্ষা অফিসারদের আলোচনা সভায় আমরা উপস্থিত ছিলাম না। নিজেদের সাফাই হিসাবে সভাপতি জানান, করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় ওইদিন সভায় উপস্থিত হতে পারিনি। তবে তাদের দু’জনের বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়েছেন সভায় আলোচনায় থাকা ১২ জন সচিব ও শিক্ষক সমিতির নেতারা। তারা দাবি করেন শিক্ষা অফিসারের আলোচনা সভায় পরিমল কর্মকার, দেলওয়ার হোসেন ও গনেশ চন্দ্র সাহা টাকা তোলার বিষয়ে সম্মতি দেন।
এ বিয়য়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলন বলেন, ‘চলতি বছরের জুনের প্রথম সপ্তাহে আমার অফিসে শিক্ষক সমিতির নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসেছিলাম ঠিকই, তবে স্কুলের বরাদ্দ থেকে টাকা তোলায় আমি রাজি ছিলাম না। আমার অফিসের সহকারী শিক্ষা অফিসার শাহ আলমের নির্দেশে শিক্ষক সমিতির নেতারা অফিস খরচ বাবদ কিছু টাকা তুলেছে। তবে স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা উঠানো ঠিক হয়নি।’ জেলা শিক্ষা অফিসার মো. রুহুল আমিনের সাথে মুঠো ফোনে কথা হলে তিনি শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসের দুর্নীতির ব্যাপারে বক্তব্য দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। শ্যামনগরের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বলেন, শিক্ষকরা জাতির মেরুদন্ড। আর শিক্ষা অফিসারদের দুর্নীতিতে শিক্ষক নেতাদের সহযোগিতায় অপকর্মে লিপ্ত হওয়ায় শিক্ষক সমাজের মুল্যবোধ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।