পরীক্ষা ছাড়াই পরের সেমিস্টার, ঢাবি শিক্ষার্থীদের অনিশ্চিত যাত্রা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ মহামারীর মধ্যে সেশনজট এড়িয়ে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এক সেমিস্টারের পরীক্ষা না নিয়েই অনলাইনে পরবর্তী সেমিস্টারের কাস চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; কিন্তু তাতে যে নতুন জটিলতার উদ্ভব হচ্ছে, তার কোনো সমাধান আপাতত নেই কর্তৃপরে হাতে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, দুই সেমিস্টারের পরীক্ষা একসঙ্গে দিতে গেলে তাদের ওপর চাপ পড়বে। ফাইনাল পরীক্ষা যদি একসঙ্গে দেওয়াও যায়, শ্রেণি পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, টার্ম পেপার ও মিডটার্ম পরীক্ষার কী হবে, সেই নম্বর কীভাবে বিবেচনা করা হবে, সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর তারা এখনও পাননি। ফলে পুরো সেমিস্টার পদ্ধতিই লেজে-গোবরে দশায় পড়বে। তবে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলছেন, আপাতত শিক্ষার্থীদের তি কমানোর পাশাপাশি তাদের পড়ালেখায় সম্পৃক্ত রাখার ওপরই জোর দিচ্ছেন তারা।
তিনি বলেন, “ভার্চুয়ালি কাস নিলেও পরীক্ষা নেওয়া তো সম্ভব হচ্ছে না। আর আমাদের কাছে সেরকম কোনো বিশ্বাসযোগ্য সফটওয়্যারও নেই। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর সংশ্লিষ্ট সবার সাথে আলোচনা করেই পরীক্ষা নেওয়া হবে।” পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩টি বিভাগ ও ১২টি ইনস্টিটিউটের মধ্যে ৪৯টি বিভাগ-ইনস্টিটিউটেই সেমিস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলে। ছয় মাসে একটি সেমিস্টার সম্পন্ন হয়। এভাবে চার বছরে আটটি সেমিস্টারে স্নাতক ও এক বছরে দুই সেমিস্টারে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান একজন শিার্থী।
প্রতি সেমিস্টারে ১৫ সপ্তাহ কাস, এক সপ্তাহ পরীক্ষার প্রস্তুতিকালীন ছুটি ও তিন সপ্তাহ পরীক্ষার জন্য বরাদ্দ থাকে। কাসের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দলভিত্তিক আলোচনা, উপস্থাপনা, শ্রেণি পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, টার্ম পেপার ও মিডটার্ম পরীক্ষা নেওয়ার হয়। কাসে উপস্থিতিসহ সেমিস্টার চলাকালে এসব মূল্যায়নে বরাদ্দ থাকে প্রত্যেক কোর্সের ৫০ শতাংশ নম্বর। বাকি ৫০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন হয় সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষায়। দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত ১৮ মার্চ থেকে ছুটি ঘোষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলসহ ক্যাম্পাস পরে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুরুতে অনলাইন কাস নিয়ে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু পরে মহামারী দীর্ঘায়িত হতে থাকায় জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে অনলাইনে কাস নেওয়া শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের চলমান সেমিস্টার জুলাই মাসেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মহামারীর কারণে তা পিছিয়ে যায়। গত তিন মাসে কিছু বিভাগ কাস শেষ করতে পারলেও বিশ্ববিদ্যালয় না খোলায় পরীক্ষা আটকে থাকে। এ পরিস্থিতিতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর চলমান সেমিস্টারের পরীক্ষা না নিয়েই অনলাইনে পরবর্তী সেমিস্টারের কাস চালিয়ে যেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগ ও ইনস্টিটিউটকে চিঠি দেয় রেজিস্ট্রারের কার্যালয়। ইতোমধ্যে বেশ কিছু বিভাগ ও ইনস্টিটিউট পরবর্তী সেমিস্টারের অনলাইন কাস শুরু করলেও নানা সীমাবদ্ধতা ও জটিলতার কারণে অধিকাংশ বিভাগ-ইনস্টিটিউট এখনও তা পারেনি। শিক্ষার্থীদের অনেকের ডিভাইস নিয়ে সঙ্কট, ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ, প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক সমস্যাসহ সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে অনলাইন কাসে সকল শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণি শিার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, “অনলাইনে প্রথম সেমিস্টারের কাস শেষ করা হয়েছে, কিন্তু পরীা তো হয়নি। করোনার আগে আমরা শুধু কয়েকটা কাস টেস্ট দিতে পেরেছিলাম। এখন আবার দ্বিতীয় সেমিস্টারের কাস শুরু করার কথা শুনছি। “তাহলে তো দুইটা সেমিস্টারের পরীা একসাথেই দিতে হবে। ফাইনাল পরীা একসাথে নিলেও মিডটার্ম, অ্যাসাইনমেন্ট, থিসিস এগুলোতে একসাথে নেওয়া সম্ভব না। এখানে একটা জটিলতা থাকছেই।” অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিরিনা আক্তার বলেন, “আমাদের বিজনেস ফ্যাকাল্টির সব বিভাগেই এ বছরের দ্বিতীয় সেমিস্টারের কাস চলছে। বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় খুললে একসাথে পরীা নেওয়া হবে।”
তিনি জানান, অনলাইন কাসের জন্য ফ্যাকাল্টির উদ্যোগে শিার্থীদের একটি করে ইন্টারনেট সিম দেওয়া হয়েছে, তাতে মাসে ২২০ টাকা রিচার্জ করলে ৩০ জিবি ডেটা পাওয়া যায়। “তাতে অনলাইন কাস না হয় চালিয়ে যাওয়া গেল, কিন্তু কোনো পরীা তো দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।” ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের হাসানুজ্জামান জানান, তাদের পঞ্চম সেমিস্টারের কিছু কাস এখনও বাকি। অনলাইনে কাস হলেও কাসে সবার উপস্থিতি না থাকায় কোনো অ্যাসাইনমেন্ট বা পরীা নিতে পারছেন না শিকরা। “প্রথম দিকে ৭০-৮০% শিার্থী কাসে জয়েন করত। এখন সেটা ৪০-৫০% এ নেমে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারনেট ডেটা বা ডিভাইস দেওয়ার কথা ছিল, কিন্ত তিন মাস হয়ে গেল, কোনো কিছুর নাম নাই।” পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শৈবাল রায় জানান, তাদের শিা কার্যক্রম চলে বার্ষিক পদ্ধতিতে। “অনলাইনে কাস চলছে। তবে উপস্থিতির সংখ্যা কম। আমাদের বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় খুললে অনলাইন কাসগুলো প্রয়োজনে রিভিউ করে পরীা নেওয়া হবে।” কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হেসেন জানান, তাদের অ্যাকাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে ১৩ বা ১৪ অক্টোবর থেকে পরবর্তী সেমিস্টার শুরুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে অনেক বিভাগের আগের সেমিস্টার শেষ হয়নি।
ব্যবসা শিা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আব্দুল মঈন বলেন, “শিার্থীদের পড়ালেখার সাথে সম্পৃক্ত রাখতে আপাতত কাস নেওয়া হচ্ছে। এখন তো আর পরীা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে কর্তৃপ যেভাবে চিন্তা করে, সেভাবেই পরীা নেওয়া হবে।” তবে কাসে শিার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সহায়তাও যে করা প্রয়োজন, সে কথা ডিনরাও বলছেন। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সকল শিার্থী তো আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থীদের মতো সচ্ছল না। তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে শিার্থীদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেওয়া উচিত।” ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিভাগ থেকে চাহিদা নেওয়া হলেও কেন তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, তা ‘জানা নেই’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। সাদেকা হালিম বলেন, “আমরা একটা বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সেখানে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি পাবে আমাদের শিার্থীরা। যাদের অনলাইন কাসে জয়েন করতে সমস্যা, তাদের আইডেন্টিফাই করে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেওয়া উচিত। ইতোমধ্যে অনেক বিভাগ নিজেদের উদ্যোগে সেটা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়েরও উচিত পরবর্তী সেমিস্টার শুরুরআগে কেন্দ্রীয়ভাবে দ্রুত শিার্থীদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠতে সহায়তা করা ।” বিজ্ঞান অনুষদের অধিকাংশ বিভাগে বার্ষিক পদ্ধতিতে পরীা নেওয়া হয় বলে আপাতত সমস্যা ‘অত বেশি হবে না’ বলেই মনে করছেন ডিন অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ চৌধুরী।
তবে অনলাইন কাসে শিার্থীদের উপস্থিতি আগের চেয়ে কমে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, শুরুতে যেখানে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিার্থী উপস্থিত থাকত, এখন তা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। “উপস্থিতি বাড়াতে আমরা শুরুতে নিজ নিজ বিভাগের উদ্যোগে শিার্থীদের সহায়তা করেছি। আমরা এটাও বলেছি, আমাদের অনুষদের কোনো শিার্থীর ডেটা কিনতে সমস্যা থাকলে যেন যোগাযোগ করে। সেন্ট্রালি বিশ্ববিদ্যালয় শিার্থীদের সহায়তার জন্য কী করছে সেটা আমার জানা নেই।” এক সেমিস্টারের পরীা না নিয়ে পরবর্তী সেমিস্টারের কাস শুরু করলে যেসব সম্ভাব্য অসুবিধার কথা শিার্থীরা বলছেন, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিা) অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, “সমস্যা তো কিছুটা থাকেবেই। আমাদের ল্য হল সমস্যাটাকে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসা, যাতে বড় ধরনের সমস্যা বা সেশনজট সৃষ্টি না হয়।” এখন যাদের সেমিস্টার শেষ, তাদের যেন বসে থাকতে না হয়, সেজন্যই পরের সেমিস্টারের কাস শুরুর সিদ্ধান্ত হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর বা পরীা নেওয়ার আগে শিক-শিার্থীদের সাথে আলোচনা করে যেখানে রিভিউ কাস নেওয়া দরকার, যতগুলো রিভিউ কাসের প্রয়োজন, সেভাবেই কাস নিয়েই আমরা তাদের পরীাগুলো নেব।” আর উপস্থিতি বাড়াতে শিার্থীদের সহায়তার বিষয়ে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশিন অসচ্ছল শিার্থীদের তালিকা চেয়েছে। কিন্তু যে ফরম্যাটে তালিকা চেয়েছে, আমাদের ডিপার্টমেন্টগুলো সেভাবে দিতে পারেনি । তাই কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।” শিার্থীদের মধ্যে যারা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শ্রেণির সমাপনী পর্যায়ে ছিল, তাদের পরীা এখনই কোনোভাবে নেওয়া যায় কি না, সেই ভাবনার কথাও অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন। “সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট আর শিার্থীদের সাথে আলোচনা করে, তারা যদি নিজ উদ্যোগে ঢাকায় কোথাও থেকে পরীা দিতে পারে, তাহলে পরীাগুলো নেওয়া যায় কি না, সেটা বলা হয়েছে। তবে সেজন্য অনুমতিরও বিষয় আছে। যাদের ভাইভা বাকি আছে, তাদের অনলাইনে নিয়ে ফলাফল ঘোষণা করতে বলা হয়েছে।”