কালো হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার নদীর পানি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ক্রমাগত নিজের বর্ণ হারিয়ে কালো হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সহ এশিয়ার নদীগুলোর পানি। বস্ত্রশিল্পের ডাই গিয়ে মিশছে নদীর পানিতে। এতে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। একই সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রচ- ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। অনলাইন সিএনএনে এ নিয়ে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন লিখেছেন সাংবাদিক হেলেন রিগ্যান। তিনি লিখেছেন, ঢাকার কাছে সাভারে বাড়ি হাজী মুহাম্মদ আবদুস সালামের। এই সাভার এখন গার্মেন্ট শিল্পের যেন প্রাণকেন্দ্র। হাজী আবদুস সালাম তার বাড়ির কাছে আবর্জনায় ভরা নদীর দিকে তাকিয়ে স্মরণ করেন সেখানে কারখানা স্থাপনের আগের সময়।
তিনি বলেছেন, যখন আমার বয়স অল্প দেখেছি কোনো গার্মেন্ট কারখানা ছিল না সাভারে। আমরা মাঠে ফসল ফলাতে পারতাম। পানিতে নানা রকম মাছ ধরতাম। আবহাওয়াও ছিল চমৎকার।
কিন্তু এখন তার পাশ দিযে যে নদী বয়ে গেছে তার পানি কালো। আবদুস সালাম বলেন, পাশের গার্মেন্টগুলো থেকে ময়লা আবর্জনা আর ডাই এসে পানি দূষিত করেছে। এতে এখন আর কোনো মাছ নেই। পানি এতটাই দূষিত যে, আমাদের ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতিরা আমাদের আগেকার দিনের একই রকম অভিজ্ঞতা পাচ্ছে না।
চীনের পরেই তৈরি পোশাকের সর্বোচ্চ প্রস্তুতকারক এখন বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে এ খাত থেকে ৩৪০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এখানে যেসব পোশাক তৈরি হয়, ডাই করা হয় এবং ফিনিশিং করা হয় তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপোর প্রধান সড়কগুলোর দোকানে দোকানে বিক্রি হয়। শিল্পখাতে যে পরিমাণ পানি দূষিত হয় তার ৫ ভাগের এক ভাগের জন্য দায়ী এসব ফ্যাশন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর নিয়মনীতি এবং আইন প্রয়োগের দুর্বলতাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। এসব দেশে দূষিত পানি সরাসরি নদী বা খালে ফেলা হয়। এই দূষিত পানিতে মাঝে মাঝেই থাকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, ডাই, লবণ ও ভারি ধাতু। এটা শুরু পরিবেশের ক্ষতিই করছে না। একই সঙ্গে পানীয় জলের উৎসকেও দূষিত করছে। তৈরি পোশাকখাত এবং বস্ত্রশিল্প সহ সর্বোচ্চ রপ্তানিখাতগুলো থেকে পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব সর্বনি¤œ পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য সচেষ্ট বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সিএনএন’কে পাঠানো এক ইমেইল বার্তায় মন্ত্রী শাহাবউদ্দিন বলেছেন, দূষণ রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সংরক্ষণ ও পরিবেশ বিষয়ক আইন আধুনিক করা। দূষণকারীদের জরিমানা করা। পানির গুণমত মাণ পর্যবেক্ষণ করা। কেন্দ্রীয় ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন। বর্জ্যপানি শোধন প্রক্রিয়া উন্নত করতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে।
ঢাকা ভিত্তিক এনজিও আগ্রহ-এর প্রধান নির্বাহী রিদওয়ানুল হক বিষাক্ত রাসায়নিক দূষণকে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য বিরাট সমস্যা বলে অভিহিত করেছেন। এখানে উল্লেখ্য, তার এই এনজিও দেশের প্রান্তিক সম্প্রদায়কে বিনামূল্যে পানীয় পানি এবং বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকার ভিতর দিয়ে যেসব নদী বা খাল প্রবাহিত তা পিচকালো রঙ ধারণ করেছে। কারণ, এতে মিশছে টেক্সটাইলের ডাই ও প্রসেসিং কারখানার বর্জ্য আর স্যুয়ারেজের ময়লা। এসব পানি খুব ঘনভ ভারি। শীতের সময় এ থেকে মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়ায়।
সাভারে ১৮ বছর ধরে বসবাস করছেন ৫৫ বছর বয়সী একজন। তিনি প্রতিশোধ নেয়া হবে এই ভয়ে নাম প্রকাশ করতে চান না। তিনি বলেছেন, দূষিত পানিই তার পরিবারের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। যদি তিনি সেখানে থাকেন তাহলে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই এই পানির কারণে তার দুই সন্তান ও নাতিপুতি তাদের সঙ্গে সেখানে থাকে না।
ইলেন ম্যাকআর্থুর ফাউন্ডেশনের হিসাব মতে, ফ্যাশন কারখানা প্রতি বছর প্রায় ৯৩০০ কোটি ঘনমিটার পানি ব্যবহার করে। এই পানি দিয়ে ৩ কোটি ৭০ লাখ অলিম্পিক সুইমিং পুল ভরে ফেলা যাবে। জাতিসংঘের হিসাবে, একজোড়া জিন্স তৈরিতে প্রয়োজন হয় প্রায় ৭৫০০ লিটার পানি। এতে নীল রঙ নিশ্চিত করতে কাপড়কে বার বার বিপুল পরিমাণ ডাইয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। ডাইয়িং শেষে, একে আরো রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে ধৌত করা হয়, কাপড়কে নরম করার জন্য। এছাড়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয় আরো রাসায়নিক পদার্থ। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রকম এসিড, এনজাইম, ব্লিচিং পাউডার, ফরমালডিহাইড। তবে পরিবেশ দূষণের জন্য একমাত্র জিন্সের কাপড়ই দায়ী নয়। ফোনে চীনের শীর্ষ স্থানীয় একজন পরিবেশবিদ মা জুন বলেছেন, আমরা জানি প্রতি বছর ফ্যাশন বিষয়ক কারখানা নতুন নতুন রঙকে হাইলাইট করে। কিন্তু প্রতিবার যখন আপনি নতুন নতুন রঙ তৈরি করবেন, ততবারই আপনাকে নতুন নতুন রাসায়নিক পদার্থ, ডাই ব্যবহার করতে হবে। এসব শেষে কারখানাগুলো অব্যবহৃত রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্যপানি থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ উপায় হিসেবে বেছে নেয় পার্শ্ববর্তী নদী বা খাল।
এ শিল্পে ব্যবহৃত সব রাসায়নিকই ক্ষতিকর নয়। তবে বিশ্বব্যাংক এ খাতের ৭২টি পণ্যকে বিষাক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই বর্জ্য যখন নদী বা খালে গিয়ে মেশে তখন সূর্য্যরে আলো পানির তলদেশে যেতে বাধা দেয়। এরফলে নদী বা খালের তলদেশে যেসব উদ্ভিদ আছে তাদের সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় এবং তার ধারাবাহিকতায় নদী বা খালের তলদেশে থাকা উদ্ভদ ও মাছসহ অন্যান্য প্রাণী মারা যায়।
এ ছাড়াও পানিতে মেশা রাসায়নিক ও ভারি ধাতু মানুষের শরীরে জমা হয়ে নানা রকম ক্যান্সার, মারাত্মক অসুস্থতা ও ত্বকের সমস্যা বাড়ানোর ঝৃঁকি সৃষ্টি করে। এই পানি ব্যবহার করা হয় ফসল ফলাতে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, টেক্সটাইলের ডাইয়ের উপস্থিতি পাওয়া গেছে সাভারে উৎপাদিত সবজি ও ফলে।
ভারতেও অবস্থা একই রকম বলে ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।