ধর্ষণ কি অপ্রতিরোধ্য?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ দেশে গত এক সপ্তাহে সংঘটিত বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ও ঘটনার ধরন জনমনে ব্যাপক শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। ধর্ষকের নিপীড়নের হাত থেকে বাদ যায়নি প্রতিবন্ধী কিশোরী, এমনকি ছয় বছরের শিশুও। বেশিরভাগ েেত্র পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ভিক্টিমকে ছিনিয়ে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় শঙ্কা জানিয়ে মানবাধিকারকর্মী ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং বিচার প্রক্রিয়া নারীবান্ধব করতে না পারার কারণেই ধর্ষকরা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ভাবছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক হিসাবে দেখা গেছে, কেবল গত আগস্ট মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৪৯ জন নারী ও শিশু। এরমধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩২ জন। সিলেটের এমসি কলেজে শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার পর স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ এই ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তারা সবাই মতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর আগে খাগড়াছড়িতে ডাকাতি করতে ঘরে ঢুকে প্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ১৩টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলছে, আগস্টে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৩টি শিশু। ‘উই ক্যান’- এর নির্বাহী সমন্বয়ক জিনাত আরা হক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলেন, ‘ধর্ষণ করতে সময় লাগে কয়েক মিনিট, কিন্তু বিচার পেতে সময় লেগে যায় ১৬/১৭ বছর, বা আরও বেশি। প্রশ্ন হলো, কোনটা সহজ। দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ, জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে প্রশাসন, সরকারি তেলবাজ উকিল, পুরুষ আধিপত্যশীল আদালত প্রক্রিয়া, সব ডিঙ্গিয়ে সমাজের আর সব মানুষের মাঝে বাস করে বিচার পাওয়া প্রায় অসম্ভব।’ পেশিশক্তির জয়জয়কার সর্বত্র উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘যদি দ্রুত গতিতে বিচার না করা যায়, কোনোভাবেই ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না। কারণ, ধর্ষক মনে করে, এই অপরাধে তার শাস্তির প্রক্রিয়া এতই বিলম্বিত যে, এই সময়ে যেকোনও কিছুই তার পে করা সম্ভব।’
অ্যাক্টিভিস্ট সাদিয়া নাসরিন মনে করেন, ধর্ষণ অপ্রতিরোধ্য হওয়ার সবচে বড় কারণটা হলো, বিচার প্রক্রিয়া নারীবান্ধব না হওয়া। তিনি বলেন, ‘ধর্ষক জানে যে, প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়ায় যেভাবে একজন ভিক্টিমকে প্রমাণ করতে হয় যে, সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যতগুলো ধাপ পার হয়ে ট্রায়াল ফেইস করতে হয়,এর প্রত্যেকটাই যথেষ্ট, একজন নারীকে বিচার প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে যাওয়ার জন্য। তার ওপর দীর্ঘসূত্রতা তো আছেই। ভিক্টিম খুব প্রভাবশালী হলেও অনেক বছর লেগে যায়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে খুব বেশি বিচার দৃশ্যমান হয়নি। আবার আদালত মামলা আমলে নেওয়ার আগে তদন্তের ভার পুলিশকে দেওয়া হয়। সেখানে তদন্ত প্রভাবিত হয়ে যায় বেশিরভাগ েেত্র। এসব কারণে ধর্ষক নির্ভয় হয়। এসব ঠিক করা গেলে ধর্ষণ কোণোভাবেই অপ্রতিরোধ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে না।’ দ্বিতীয় আরেকটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার অভাব রয়েছে। দিনশেষে ধর্ষণতো অবশ্যই একটি রাজনৈতিক অপরাধ। সেটা নারী-পুরুষের আন্তঃসম্পর্কের মতার রাজনীতি এবং রাষ্ট্রমতার রাজনীতি। দুটোতেই নারী ধর্ষণ একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এবং ধর্ষক এই রাজনৈতিক ফায়দাটা নিতে পারে এবং নেয়।’ মানবাধিকার কর্মী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘বেশকিছু দিন ধরে ল্য করছি, ধর্ষণ বেড়ে চলেছে। সর্বশেষ কয়েকটি ঘটনার ধরন বেশ আশঙ্কাজনক। সমতল ও পাহাড়ে পর পর কয়েকটি দলবদ্ধ ধর্ষণ ঘটনার ভয়াবহতায় সাধারণ মানুষের বোধশক্তি লোপ পেতে বসেছে। একজন নারী তার পরিবারের সঙ্গেও কোথাও গিয়ে নিরাপদ বোধ করছেন না। ভাইয়ের কাছ থেকে, স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ’ এর কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যে রাজনীতি মানুষকে স্বপ্ন দেখাবে, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, মানুষের পাশে থাকবে, তার নাম করে কিছু দুর্বৃত্ত এরকম অপরাধ করছে। কারণ, রাজনীতি দুর্বৃত্তদের হাতে চলে গেছে। চাঁদাবাজ, ঘুষখোর, অপরাধীদের সংঘবদ্ধ উপস্থিতি দলগুলোর ভেতরে ল্য করা যাচ্ছে। যে কারণে ক্যাসিনো কাণ্ডে এরা গ্রেফতার হন, ধর্ষণের ঘটনায় আসামি হন।’ রাজনৈতিক চর্চা নেই, আদর্শিক চর্চা নেই বলেই দুর্বৃত্তরা একের পর এক ধর্ষণ ঘটাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর গাফিলতি ও সার্বিকভাবে ঘৃণার সংস্কৃতি আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।’