করোনার দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের চক্রে পড়তে যাচ্ছে দেশ!

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় দফায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সংক্রমণের মাত্রাও অনেক বেশি। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ উন্মুক্ত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের শিথিলতা চলে এসেছে। এসব কারণে বাংলাদেশেও পুনরায় করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি সংক্রমণ হলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরামর্শও দিচ্ছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বর্তমানে করোনা সংক্রমণের গতি কিছুটা কম হলেও এ নিয়ে স্বস্তির কিছু নেই। আবার জনসংখ্যার তুলনায় নমুনা পরীক্ষার সংখ্যাও কম। অনেকেই থেকে যাচ্ছেন পরীক্ষার বাইরে। একইসঙ্গে আসন্ন শীতে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, সবকিছু মিলিয়ে করোনার একটা দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের চক্রে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ! দেশে ইতোমধ্যে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে তিন লাখের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর করোনা শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৭০৫ জন। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৫০ হাজার ৬২১ জন শনাক্ত হলেন। আর করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৪০ জন।  গত ২২ সেপ্টেম্বর করোনার কারণে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো পাঁচ হাজার সাত জনে। একইদিনে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন আরও এক হাজার ৫৫৭ জন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত তিন লাখ ৫২ হাজার ১৭৮ জন শনাক্ত হলেন। দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াতে থাকে। জুনে সেটা তীব্র আকার ধারণ করে। শুরু থেকেই করোনা শনাক্তে টেস্টের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দেশে প্রথমদিকে কেবলমাত্র রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ( আইইডিসিআর)-এ করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলেও দিনে দিনে সেটি বেড়েছে এবং পরীক্ষা কেন্দ্রেরও বিস্তার ঘটেছে। তবে পরীক্ষাগারের সংখ্যা বাড়লেও গত জুন মাসের শেষে করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য সরকারিভাবে ফি নির্ধারণ, টেস্ট করাতে ভোগান্তি, রিপোর্ট পেতে দেরিসহ নানা কারণে মানুষ করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহ হারায়। ফলে টেস্টের সংখ্যা কমে আসায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জনগণকে করোনা টেস্ট করানোর জন্য একাধিকবার অনুরোধ ও আহ্বান করা হয়। তারপরও মানুষকে করোনার নমুনা পরীক্ষায় আগ্রহী করানো যায়নি। একইসঙ্গে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করানোর চেষ্টায় মানুষের অবাধ চলাচল বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা, ভ্যাকসিন আসার আগেই করোনা চলে যাবার মন্তব্য, স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনাবিষয়ক বুলেটিন বন্ধ করে দেওয়ায় মানুষের মধ্যে করোনাকে পাত্তা না দেওয়ার প্রবণতা আরও বেড়েছে। অথচ করোনার লক্ষণ ও উপসর্গবিহীন রোগীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের থেকে সংক্রমিত হচ্ছেন অন্যরা। একইসঙ্গে শীতের সময়ে করোনায় আক্রান্তের হার বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে তারা দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগাম বার্তাও দিচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যেসব নির্দেশকের মাধ্যমে কোনও দেশের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিনা বলে বোঝা যায়, তার কোনোটারই প্রতিফলন বাংলাদেশে নেই। বিশ্বের যেসব দেশে সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা ভালো ছিল, সেখানে টেস্ট, ট্রেসিং, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা ভালো, মেনেও চলা হয়েছে। তারপরও কিছু কিছু দেশ দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণের কবলে পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্দেশনাগুলো মেনে চলার হার কোনোটাই পর্যাপ্ত নয়। বরং মেনে চলার প্রবণতাই নেই। যে কারণে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ এখনও দূরে। বরং সংক্রমণের একটা দীর্ঘস্থায়ী চক্রে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও জানিয়েছে, বর্তমানে করোনা পরীক্ষার হার নিম্নমুখী হলেও তা নিয়ে স্বস্তির কিছু নেই। আবার দেশের সবাইকে আবশ্যিকভাবে করোনার পরীক্ষা করাতে বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অনেকেই টেস্টের ব্যাপারটিকে খুবই হেলাফেলা করছেন। টেস্ট করাচ্ছেন না, এখানে কোনও ভুল করলে তার মাশুল আমাদের দিতে হবে। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশেও পুনরায় করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। আর সেজন্য দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি সংক্রমণ হলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মতো প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।’ স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করে আইসোলেশনে রাখা গেলেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা এখনও করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। যারা এটা করতে পেরেছে, তারা করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হচ্ছে না।’ রোগীদের যদি শনাক্ত না করা হয়, তাদেরকে যদি কোয়ারেন্টিনে নেওয়া না হয়, তাহলে তাদের মাধ্যমেও অন্যরা সংক্রমিত হবেন। এভাবেই রোগীর থেকে রোগী ছড়াচ্ছে। আবার যে বাসায় একজন সদস্য কোনোভাবে আক্রান্ত হয়ে যায়, সে বাসায় একাধিক সদস্য সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছে। এটা যদি হাসপাতালে ম্যানেজ হতো তাহলে সংক্রমণের হার কমে আসতো। এসব মিলিয়ে যে অবস্থায় আছি, তাতে করে সংক্রমণ কমার কথা নয় বরং আমরা একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের মধ্যে যাচ্ছি।’ ‘আমাদের দেশে একটা ওয়েভের ওপর আরেকটি ওয়েভ সুপার ইমপোজড হবে’ মন্তব্য করে অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘তাতে করে সংক্রমণ দীর্ঘায়িত হবে। একইসঙ্গে গ্রামে সংক্রমিত হচ্ছে, কিন্তু তারা শনাক্ত হচ্ছেন না।’ বিমান চালু হচ্ছে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যাতায়াত বাড়ছে। দেশে যারা আসছেন, তাদেরকে প্রকৃত কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন করা সম্ভব কিনা, কিংবা এসব হলে আদৌ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব কিনা, সে প্রশ্ন করেন তিনি। ‘সবকিছুই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে এবং পরীক্ষার বাইরে থাকছে অনেকেই। উপসর্গহীন রোগীরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন, যার কারণে দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের ভেতরে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, মন্তব্য করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শ কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথম যে দলকে চীনের উহান থেকে আনা হলো, তাদেরকে তো আমরা ঠিকমতো আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিন করতে পারিনি। এসব ভুল দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের। প্রথমবারে আমাদের ঘাটতিগুলো আমরা জেনেছি। কিন্তু এবারে যেন সেটা না হয়।’ তিনি বলেন, ‘এবার যদি সেটা হয় তাহলে আর রক্ষা থাকবে না। দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণে পড়বে দেশ। কিন্তু সেটা যেন না হয়—সেদিকে লক্ষ রাখা অত্যন্ত জরুরি।’