সরকারি ক্রয় খাতে রাজনৈতিক প্রভাব বড় সমস্যা: টিআইবি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সরকারি ক্রয় কাজে ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) ব্যবহার করছে চারটি প্রতিষ্ঠান। সুশাসন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, ইজিপি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, এই মাপকাঠিতে চারটি প্রতিষ্ঠানের অবস্থাই উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সরকারি ক্রয় খাতে রাজনৈতিক প্রভাবকে সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘সরকারি ক্রয় খাতে মূল সমস্যা রাজনৈতিক প্রভাব। এটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এরসঙ্গে প্রভাবশালীদের যোগসাজশে রয়েছে সিন্ডিকেট। সত্যিকার অর্থে যদি ইজিপিকে কার্যকর করতে চাই, তাহলে একে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতেই হবে এবং সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ’ বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) টিআইবি আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। ‘সরকারি ক্রয়ে সুশাসন: বাংলাদেশে ই-জিপি’র কার্যকরতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সরকারি কেনাকাটায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতিমুক্ত রাখতে ২০১১ সালে ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) চালু হয়। প্রাথমিকভাবে চারটি প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ই-জিপি বাস্তবায়ন শুরু হয়। এগুলো হচ্ছে – স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ (সওজ), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এই চার প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় ই-জিপির ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করেছে টিআইবি। এতে তাদের কার্যক্রমের ওপর স্কোর প্রদান করেছে সংস্থাটি। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্কোর পেয়েছে সড়ক ও জনপথ সওজ (৫০%)। এর পরে রয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ-আরইবি (৪৪%), পানি উন্নয়ন বোর্ড- পাউবো (৪৩%), এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর- এলজিইডি (৪২%)। প্রাপ্ত সার্বিক স্কোর অনুসারে সবগুলো প্রতিষ্ঠানের অবস্থানই ‘ভালো নয়’ গ্রেডে। এ ব্যাপারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘চারটি প্রতিষ্ঠানের যে তথ্য পেলাম, তাতে কোনও প্রতিষ্ঠানই ভালো স্কোর করতে পারেনি। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটি অবস্থা সন্তোষজনক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এলজিডির অবস্থা ঘাটতিপূর্ণ। সুশাসন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, ইজিপি ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এই মাপকাঠিতে চারটি প্রতিষ্ঠানের অবস্থাই উদ্বেগজনক। ৪০ এর নিচে স্কোর। খুবই উদ্বেগজনক। ইজিপি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সড়ক ও জনপদ ছাড়া বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠানে ঘাটতি দেখতে পেয়েছি। সার্বিকভাবে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ঘাটতিপূর্ণ।’
টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্রেডিং অনুযায়ী সব প্রতিষ্ঠানের অবস্থান সার্বিকভাবে ঘাটতিপূর্ণ। তবে ই-জিপি ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং কার্যকারিতায় অবস্থান উদ্বেগজনক। যেসব নির্দেশকের অবস্থান উদ্বেগজনক সেগুলো হচ্ছে, বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা, প্রাক-দরপত্র সভা, ই-চুক্তি ব্যবস্থাপনা, কার্যাদেশ বাস্তবায়ন তদারকি, নিরীক্ষা, কর্মচারীদের সম্পদের তথ্য প্রকাশ, অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং কাজের মান।
ইজিপিকে আরও কার্যকর করতে ১২টি সুপারিশ প্রদান করেছে টিআিইবি। সেগুলো হলো-
১. প্রত্যেক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের ক্রয় ই-জিপি’র মাধ্যমে করতে হবে।
২. ই-জিপি পরিচালনার জন্য কাজের চাপ ও জনবল কাঠামো অনুযায়ী ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে জনবল বাড়াতে হবে।
৩. ই-জিপি’র সঙ্গে সম্পর্কিত সব অংশীজনকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এর জন্য প্রতি জেলায় সিপিটিইউ’র তত্ত্বাবধায়নে একটি প্রশিক্ষণ ইউনিট গঠন করতে হবে, যারা মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় পর পর ঠিকাদার, ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৪. প্রত্যেক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (এপিপি) প্রত্যেক অর্থবছরের শুরুতে তৈরি করতে হবে ও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
৫. প্রত্যেক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে প্রাক-দরপত্র মিটিং নিশ্চিত করতে হবে।
৬. ঠিকাদারদের একটি অনলাইন ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে, যেখানে সব ঠিকাদারের কাজের অভিজ্ঞতাসহ হালনাগাদ তথ্য থাকবে। কাজের ওপর ভিত্তি করে ঠিকাদারদের আলাদা শ্রেণিবিন্যাস করতে হবে, যা সঠিক ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
৭. সিপিটিইউ-এর পক্ষ থেকে একটি সমন্বিত স্বয়ংক্রিয় দরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকতে হবে, যা সব সরকারি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করবে।
৮. সিপিটিইউ-এর পক্ষ থেকে ই-চুক্তি ব্যবস্থাপনা ও কার্যাদেশ বাস্তবায়ন তদারকি ই-জিপি’র অধীনে শুরু করতে হবে।
৯. প্রত্যেক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানকে ই-জিপি গাইডলাইন অনুযায়ী নিরীক্ষা করাতে হবে।
১০. দরপত্র সংক্রান্ত সব তথ্য ও সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের জন্য স্বপ্রণোদিতভাবে প্রকাশ করতে হবে।
১১. প্রত্যেক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের ই-জিপি’র সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিজস্ব ও পরিবারের অন্য সদস্যদের আয় ও সম্পদের বিবরণী প্রতিবছর শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে ও তা প্রকাশ করতে হবে।
১২. প্রত্যেক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্থানীয় পর্যায়ে তদারকি করতে হবে এবং এ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। এর জন্য স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে তদারকির (কমিউনিটি মনিটরিং) চর্চা শুরু করা যেতে পারে। একইভাবে প্রত্যেক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিতভাবে গণশুনানি আয়োজন করতে হবে।