খাল ভরাট করে ইটভাটা, পানির নিচে ৫ হাজার একর জমি

0

মেহেরপুর সংবাদদাতা॥ মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলায় চাতোর খাল দখল করে ইটভাট, পাকা দোকান ঘর এবং বাড়ি নির্মাণ করায় নাগা বিলে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এ কারণে ওই এলাকার প্রায় পাঁচ হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এবং কৃষকদের বাঁচাতে দ্রুততম সময়ে খাল দখলমুক্ত করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
স্থানীয়রা জানান, জনদুর্ভোগের এ চিত্র প্রতি বছর ঘটে চলেছে মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার দারিয়াপুর ও গৌরিনগর গ্রামে। গৌরিনগর গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে চাতোর খাল। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মানুষ অল্প অল্প করে দখল করে নেয় খালের অংশ বিশেষ। তারপর ভরাট করে গড়ে তোলে ইটভাটা ও দোকান পাট। এতে করে বর্ষার পানি নামার সুযোগ বন্ধ হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। পানিতে ডুবেছে স্থানীয় নাগা বিলসংলগ্ন সুঁচোখোলা মাঠ। আর এতে তলিয়ে গেছে চলতি মৌসুমের পাঁচ হাজার একর জমির ফসল।
স্থানীয়রা কৃষকরা বলছেন, ইটভাটারস্থলেই ছিল খাল, ভরাটের কারণে এখন তা বোঝার উপায় নেই। চাতোর খাল ভরাট করে হয়েছে মুকুট ব্রিকস ফিল্ড। প্রভাবশালীদের কবল থেকে খাল উদ্ধারের মাধ্যমে পুনঃখনন করে পানির প্রবাহ ঠিক না করলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। খাল দখল সম্পর্কে দারিয়াপুর ইউনিয়নের গৌরিনগর গ্রামের জমি জরিপকারী আব্দুল মজিদ বলেন, ‘প্রায় সাত কিলোমিটার দীর্ঘ ও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের ফসলি ক্ষেতের মাঝের একটি অংশ নাগা বিল। ওই জমিতে কৃষকরা বছরের তিন মৌসুমে ফসল ফলান। তবে, বর্ষায় পানি নিষ্কাশন করতে না পারলে কেবল এক মৌসুমের (চৈত্রমাসে) ধান ছাড়া বাকি দুই মৌসুমে ফসল উৎপাদন সম্ভব হবে না।’
জানতে চাইলে বাগোয়ান ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের ফিরোজ আহমেদ মাস্টার বলেন, ‘এখানে আমার চার বিঘা জমির আমন ধান ও দেড় বিঘা জমির কচু ডুবে গেছে। দেড় বিঘা জমিতে আগাম বাঁধাকপির চাষ করেছিলাম। কিন্তু পানিতে জমি ডুবে যাওয়া বাঁধাকপি নষ্ট হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘এভাবে হাজার হাজার একর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এই মৌসুমের ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে, তা আর পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। আগামী রবি মৌসুমের ফসলও আবাদ করতে পারবো কিনা, সন্দেহ রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে চলতি মৌসুমে কৃষকরা শত কোটি টাকার ফসলের ক্ষতির মুখে পড়বেন।’ গৌরিনগর গ্রামের ফকরুল ইসলাম, হারুন অর রশিদ ও দারিয়াপুর গ্রামের কুতুবউদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের আগে দারিয়াপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুল জলিল সরকারি সহায়তায় সুঁচোখোলার মাঠ থেকে নাগাবিল হয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার চাতোর খাল খনন করেন। যা গৌরিনগর গ্রামের মধ্যে দিয়ে ভৈরব নদে গিয়ে পড়ে।’
হারুন, কবির, কালাম ও কাশেমসহ মাঠে কর্মরত কয়েকজন কৃষক বলেন, খাল দখল হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার একর জমির আমন ধান, পাট, কচুসহ সব ধরনের মৌসুমি ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক কৃষক ক্ষতি কমাতে পানির নিচে থেকে ধান কেটে নৌকায় করে ডাঙায় তুলছেন। শিগগিরই পানি নিষ্কাশনের জন্য চাতোর খাল দখলমুক্ত করে পুনঃখনন না করলে শত শত কৃষককে পথে বসতে হবে। এদিকে অভিযুক্ত মুকুট ব্রিকস-এর মালিক লিংকন বলেন, ‘মেহেরপুর-মুজিবনগর সড়কের পূর্বপাশ থেকে গৌরিনগর গ্রামের মধ্যে এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পরিত্যক্ত খালটি ভরাট করে বাড়িঘর ও দোকান স্থাপনসহ যে যার মতো কাজে লাগিয়েছেন। সরকার চাইলে জনস্বার্থে আমরা আমাদের স্থাপনা সরিয়ে নেবো।’ দারিয়াপুর ইউপি চেয়ারম্যান তৌফিকুল বারী বকুল বলেন, ‘পাঁচ হাজার একরেরও বেশি জমির উঠতি ফসল পানির নিচে। কৃষকের জমির জলাবদ্ধতা রোধে খাল পুনঃখনন ও কংক্রিট ক্যানেল নির্মাণ জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, শুধু খাল পুনঃখনন করলে লাভ হবে না বরং ক্ষতিই হবে কারণ অতীতে দেখা গেছে বর্ষা মৌসুমে ভৈরব নদীর পানি উল্টো খাল বেয়ে গ্রামের ভেতরে চলে আসে। গোপালগঞ্জে ও ঢাকার বসুন্ধরায় দেখে আসা কংক্রিট ক্যানেলের মতো গ্রামের ভেতরে স্লুইসগেটসহ ক্যানেল নির্মাণের জন্য আলোচনা করছি। কিছুদিন আগে চুয়াডাঙ্গা থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা সরেজমিনে পরিদর্শনে আসলে তাদেরকে বুঝিয়ে বলা হয়েছে। মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজন সরকার বলেন, ‘জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের নির্দেশে পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় (এলজিইডি) ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে এলাকা পরিদর্শন করেছি। শিগগিরই খালটি পুনরুদ্ধারসহ পুনঃখনন করা হবে।’ প্রয়োজনে খালে ডাবল স্লুইসগেট করা হবে বলেও জানান তিনি।