পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি: ‘অভিযান আর আমদানির’ বিকল্প নেই

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ কোনও প্রকার আগাম নোটিশ ছাড়াই বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত সরকার। এমন সংবাদে সোমবার (১৪ সেপ্টেম্বর) থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের পেঁয়াজের বাজার। প্রতি ঘণ্টায় বাড়ছে এই পণ্যটির দাম। ক্রমশই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে পেঁয়াজের বাজার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে। বাজার বিশ্লেষকরাও মনে করেন, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা জরুরি। সেই সঙ্গে পেঁয়াজ আমদানির বিকল্প নেই। তবে বাজারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। প্রতিঘণ্টায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। রাজধানীর বাজারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও ১০০ টাকা, আবার কোথাও ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন পেঁয়াজের বাজারে। কেউ পাঁচ কেজি, কেউবা ১০ কেজি করে যে যেভাবে পারছেন মজুত করছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ক্রেতাদের এমন আচরণও বাজারকে অস্থির করার পেছনে বড় কারণ। জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের পরিকল্পনায় রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি বাজারে অভিযান চলছে। অধিদফতরের চারটি টিমসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তিনটি মনিটরিং টিম এই অভিযান পরিচালনায় অংশ নিয়েছে। পেঁয়াজের বড় পাইকারি আড়ত শ্যামবাজারেও অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনও ব্যবসায়ী যদি অনৈতিকভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়ায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কিছু অসৎ ব্যবসায়ী সব সময় সুযোগ পেলেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে। তাদের এই সুযোগ দেওয়া হবে না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন বলেন, ‘দেশে পেঁয়াজের কোনও ঘাটতি হয়নি। সংকটও নেই। বাজার ব্যবস্থাপনায় সরবরাহে কোনও ত্রুটি দেখা দেয়নি। কাজেই পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই। তারপরেও আমরা চেষ্টা করছি পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এ জন্য আমরা বাজারে মোবাইল কোর্টের অভিযান পরিচালনা করছি। অপরদিকে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির ব্যবস্থাও করছি। আশা করছি কিছু সময়ের মধ্যেই বাজারে পেঁয়াজের দাম কমে আসবে।’ বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির বক্তব্য জানতে বারবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি ফোন রিসিভ করছেন না। এ বছর দেশে যথেষ্ট পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদন এবং একইসঙ্গে আমদানিও হয়েছে। এরপরও কেন এই মূল্য বৃদ্ধি, এ প্রশ্নে পেঁয়াজ আমদানিকারক আলম সরদার বলেন, ‘সরকারের গাফিলতি এখানে বড় কারণ। সব সময় বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম ভারতের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু কিছু দিন যাবৎ সীমান্তের স্থলবন্দরগুলোতে বিশেষ করে বেনাপোল ও হিলি বন্দরে এ নিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা হচ্ছিল, সেহেতু আগে থেকেই সরকার বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। সেটি করা হলে বাজার এত অল্প সময়ের মধ্যে নাগালের বাইরে যেতো না।’ তিনি বলেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, পেঁয়াজের বাজারে পরিচালিত অভিযানের ফল ভালো হয় না। হিতে বিপরীত হতেও দেখেছি। কারণ, ব্যবসায়ীরা যদি কমিশনে ব্যবসা করেন, তাহলে সেখানে অভিযান পরিচালনা করে লাভ হবে না। কারণ, দাম বাড়ার পেছনে তারা দায়ী নয়। সিন্ডিকেট বা কারসাজির শেকড় খুঁজতে হবে। এর জন্য সব ব্যবসায়ী দায়ী নয়।’
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ মেট্রিক টন। এ বছর দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ২৫ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন। যেহেতু পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য, তাই প্রতিবছরই উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০ শতাংশ পচে গিয়ে ভালো থাকে ১৯ লাখ ১১ হাজার মেট্রিক টন। এবারও তা-ই হয়েছে। এখানেই মূলত ঘাটতি তৈরি হয়। আর এই ঘাটতির পরিমাণ ৫ থেকে ৭ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে এই ৭ লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি মেটাতে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রতিবছর আমদানিও হয় ৮ থেকে ১০ লাখ টন, যা চাহিদা বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। আমদানিনির্ভর এই ৭ লাখ টন পেঁয়াজ দেশে উৎপাদিত ১৯ লাখ টন পেঁয়াজকে প্রভাবিত করে। আমদানিতে সামান্য কোনও ত্রুটি দেখা দিলেই ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে থাকে। আর তখনই অস্থির হয়ে ওঠে দেশের পেঁয়াজের বাজার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছর ধরে ৩০ শতাংশ বাদ দিয়ে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ১৭ থেকে ১৮লাখ মেট্রিক টনে স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু এই সময়ে আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয় ৭ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন। ১০ বছরের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৩৮ হাজার টন। এ হিসাবে ১০ বছরের ব্যবধানে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে ১৩৬ শতাংশ বা ২ দশমিক ৩৬ গুণ। এ সময়ে হেক্টরপ্রতি ফলন ৬ দশমিক ৮১ টন থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৭৬ টন হয়েছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। ফলে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পেঁয়াজের আমদানি।২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১ লাখ ৩৪ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হলেও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৬৪ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে ৪ লাখ ৫৯ মেট্রিক টন। ১০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে ২ দশমিক ৩৬ গুণ, আর আমদানি বেড়েছে ৭ দশমিক ৯ গুণ। আর এই আমদানিতে কোনও কারণে ঘাটতি হলে এর সঙ্গে যুক্ত হয় একশ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ীর কারসাজি, যা বাজারকে অস্থির করে তোলে।