কিশোর আসামিদের স্বীকারেক্তিতে মামলার তদন্ত কাজ এগুচ্ছে দ্রুত

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ যশোরে চাঞ্চল্যকর তিন কিশোর বন্দি হত্যার এক মাস পূর্ণ হলো আজ। গত ১৩ আগস্ট দুপুরে যশোরের পুলেরহাটস্থ শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তুচ্ছ ঘটনায় অভ্যন্তরীণ সাজা দেয়ার নামে ১৮ বন্দির ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায় কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। ওই নির্যাতনের ফলের তিন বন্দি মারা যায়, আহত হয় ১৫জন। নিহতরা হলো, বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্বপাড়ার নান্নু পরামানিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), একই জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) এবং খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮)। এই ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। সমাজসেবা অধিদফতর ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার ঘটনাটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়। আটক করা হয় কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ ৫ কর্মকর্তাকে। তাদের নামে হত্যার মামলা হয়। এই মামলায় আসামি করা হয় ওই কর্মকর্তাদের অনুগত আরও ৮ বন্দিকে। গঠিত হয় দুটি তদন্ত কমিটি। এরমধ্যে সমাজসেবা অধিদফতরের উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটিও ছিল। উভয় কমিটি ঘটনার সত্যতা পায় এবং জমা দেয়া রিপোর্টে নানামুখী সুপারিশ করা হয়। এখন মূল কাজ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার হাতে। নিহত রাব্বির বাবা রোকা মিয়ার কোতয়ালি থানায় দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়। আর এই মামলাটির তদন্ত করছেন চাঁচড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক রোকিবুজ্জামান। তিনি জানিয়েছেন, মামলাটি হাতে পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় আইনি সকল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আসামিদের (৫ কর্মকর্তা) রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বাকি ৮ কিশোর আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। ফলে মামলার তদন্তকাজ দ্রুত এগুচ্ছে।
তিনি আরও জানিয়েছেন, খুলনা বিভাগীয় উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মামলাটি স্পেশাল ভাবে দেখছেন। দুটি তদন্ত কমিটির সুপারিশ হাতে পাওয়ার পর তদন্ত কার্যক্রম সহজে শেষ করা সম্ভব হবে। তবে তদন্ত কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারা দোষী বা কতটুকু দায়ী এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে না বলে তিনি জানিয়েছেন। ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ৩ আগস্ট। এদিন কিশোর বন্দি হৃদয়কে চুল কেটে দিতে বলেন কেন্দ্রের নিরাপত্তা প্রধান নূর ইসলাম। ঈদের আগে হৃদয় প্রায় দু শ বন্দির চুল কেটে দেয়ায় তার হাত ব্যথা হয়েছে। এ কারণে পরে চুল কেটে দেয়া হবে বলে জানালে ক্ষুব্ধ হন নুর ইসলাম। তিনি কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহর কাছে মিথ্যা অভিযোগ করেন যে, হৃদয়সহ বেশ কয়েকজন নেশা করেছে। এছাড়া হৃদয়ের সাথে বন্দি পাভেলের সমকামী সম্পর্ক আছে। ওই নালিশ শুনে ফেলে অপর বন্দি নাইম। সে বিষয়টি পাভেলকে জানায়। তখন পাভেলসহ তার অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হয়। তারা নুর ইসলামকে মারধর করে। এতে নুর ইসলামের হাত ভেঙে যায়। জাতীয় শোকদিবস পালন উপলক্ষে ১৩ আগস্ট যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় নূর ইসলামের ওপর হামলাকারীদের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় শাস্তির। ওই ৫ কর্মকর্তার সাথে তাদের অনুগত আরও ৭/৮জন বন্দি ওই ১৮ জনকে মারধর করে। মুখে গামছা ঢুকিয়ে জানালা দিয়ে হাত বাইরে বের করে টেনে ধরে পেছনে লোহার রড, ক্রিকেট স্ট্যাম্প ইত্যাদি দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। অচেতন হওয়ার জ্ঞান ফিরলে ফের মারধর করা হয়। পালাক্রমে এভাবে মারধরের পর গুরুতর জখম অবস্থায় এদের একটি ঘরে ফেলে রাখা হয়। একজন ‘কম্পাউন্ডার’ দিয়ে সামান্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও এদের হাসপাতালে না পাঠিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা ফেলে রাখা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মৃতপ্রায় অবস্থায় একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতাল থেকে খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনসহ কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে এক অবর্ণনীয় পরিবেশ দেখতে পান। নির্যাতনের শিকারদের দুপুরে খাবার না দিয়ে, চিকিৎসা না দিয়ে গরমের মধ্যে গাদাগাদি অবস্থায় ফেলা রাখা হয়েছিল। এরই মধ্যে আরও দুজনকে হাসপাতালে পাঠানো হলে তারাও মারা যায়। পরে ডরমেটরিতে ঢুকে প্রশাসনের কর্মকর্তারা দেখেন আরও ১৪/১৫ জন কাতরাচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের পিকআপে করে ১৪ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরদিন আরও একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এনিয়ে এই মর্মান্তিক ঘটনায় তিনজন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছিল।