ভেন্টিলেটর ভেঙে বাসায় ঢুকে ইউএনও’র ওপর হামলা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম (৩৫) ও তার বাবা অমর আলীকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। বুধবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ইএনও’র সরকারি বাসভবনের ভেন্টিলেটর ভেঙে এই ঘটনা ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। হাসপাতালে আনার পর ওয়াহিদা খানমের অবস্থার আরও অবনতি হয়। তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে ঢাকায় স্থান্তান্তর করা হয়। শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হলে দেশের বাইরে নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তার অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত অপারেশনও করা যাবে না বলে জানিয়েছেন রাজধানীর নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এঘটনায় উপজেলা পরিষদের নৈশপ্রহরী পলাশকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। দিনাজপুর গোয়েন্দা পুলিশের ওসি ইমাম আবু জাফর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ, স্থানীয় কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাতের আঁধারে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের সরকারি বাসভবনে হামলা করে দুর্বৃত্তরা। গেটে দারোয়ানকে বেঁধে ফেলে তারা। পরে বাসার পেছনে গিয়ে মই দিয়ে উঠে ভেনটিলেটর দিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে ঢুকে ভারি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও আঘাত করে ইউএনও ওয়াহিদাকে গুরুতর আহত করে হামলাকারীরা। মেয়েকে বাঁচাতে এলে তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখকে (৭০) জখম করে। তারা অচেতন হয়ে পড়লে মৃত ভেবে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। ভোরে স্থানীয়রা টের পেয়ে তাদের উদ্ধার করেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩ সেপ্টেম্বর) সকালে ইউএনও ওয়াহিদাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রংপুরে কমিউনিটি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সিসিইউ নেওয়ার পর অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় পাঠানো হয় তাকে। নিজের কন্যাকে রা করতে বৃদ্ধ বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখ (৭০) এগিয়ে গেলে তাকেও আহত করে সন্ত্রাসীরা। তাকে আহত অবস্থায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়, পরে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. ফরিদুল ইসলাম। ওমর আলী পুলিশকে বলেছেন, রাতে বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙে কেউ একজন বাসায় ঢোকে। ওয়াহিদা খানম টের পেয়ে এগিয়ে গেল তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। এ সময় ওমর আলী এগিয়ে গেলে তাকেও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে হামলাকারী পালিয়ে যায়। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওসি বলেন, “ওই বাসা থেকে কোনো কিছু খোয়া যায়নি। এটি ডাকাতির চেষ্টা, না আক্রোশ’ থেকে কেউ হামলা করেছে, সেটা পুলিশ খতিয়ে দেখছে।”
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাজকুমারসহ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইউএনওকে পরীা করে সাংবাদিকদের জানান, তার মাথার আঘাত গুরুতর। হাড় দেবে গেছে। তার একটি হাত ও শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে গেছে। ডা. রাজকুমার বলেন, ‘দ্রুত অস্ত্রোপচার করা জরুরি। সেজন্য তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি অপারেশন করা যাবে ততই তার জন্য মঙ্গল।’
ঢাকার জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক বদরুল আলম গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, “উনাকে ঢাকায় এনে প্রথমে সিএমএইচে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে আমাদের এখানে আনার কথা রয়েছে। আমরা প্রস্তুত আছি।” এর আগে ওয়াহিদা খানমকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার যোগে রংপুর হতে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়। দুপুরে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের নিউরো সার্জারির অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, এ মুহূর্তে অপো করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। ইউএনও-এর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার রক্তচাপ ও পালস স্বাভাবিক না হলে অবস্থা আরও সংকটাপন্ন অবস্থা হবে। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব সিদ্ধান্ত মেডিক্যাল বোর্ডের চিকিৎসকরা মিলেই নিয়েছেন। পুরো টিম মিলে তাকে দেখেছেন, অবজারভেশনে রেখেছেন। মেডিক্যাল বোর্ডে আছেন নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ, যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম, অধ্যাপক ডা. জহির, আইসিইউ কনসালটেন্ট ডা. উজ্জ্বল কুমার মল্লিক, অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ খান, অধ্যাপক ডা. মাহফুজ। এই মুহূর্তে তাকে দেশের বাইরে নেওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে ডা. জাহিদ বলেন, তার ব্রেনে আঘাত লেগেছে। খুলি ভেঙে ভেতরে ঢুকে যাওয়ায় ভেতরে রক্তরণ হয়েছে। রক্তচাপ-পালসও ঠিকমতো নেই। উন্নতি হলে পরবর্তী পদপে নেওয়া যাবে।
এদিকে ঘোড়াঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুর রাফে খন্দকার ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নুর নেওয়াজ আহমেদ স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানান, রাত আড়াইটা বা ৩টার দিকে উপজেলা পরিষদ চত্বরে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের সরকারি বাসায় হামলা হয়। তখন উনারা সাহায্যের জন্য চিৎকার করেছেন কিনা তা স্থানীয়রা বলতে পারছেন না। ভোরে উনার বাবা হাঁটতে বের না হওয়ায় তার সঙ্গীরা বাসায় গিয়ে খোঁজ নেন। বাড়িতে ডাকাডাকি করেও কোনও সাড়া না পেয়ে পুলিশকে খবর দেন তারা। পরে পুলিশ এসে ইউএনও ও তার বাবাকে আহতাবস্থায় দেখে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পুলিশ জানায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের একটি ছোট সন্তান রয়েছে। তার স্বামী রংপুরের পীরগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত। তিনি মাঝে মাঝে আসেন। তার বৃদ্ধ বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখ সম্প্রতি মেয়ের কাছে এসেছেন। আহত ইউএনও’র মা রমিসা খাতুন নওগাঁ থেকে জানান, বুধবার সন্ধ্যায় ফোনে তার মেয়ের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তবে কারা, কেন তার মেয়ের বাসায় ঢুকে তাকে হত্যা করার জন্য কুপিয়েছে তা তিনি জানেন না। তিনি দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
জেলা প্রশাসক হামিদুল আলম বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘হত্যার উদ্দেশ্যেই এই হামলা চালানো হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। তদন্ত করার পর পুরো ঘটনা জানা যাবে।’ এদিকে ঘোড়াঘাট থানার ওসি আমিরুল ইসলাম জানান, ‘কারা কীভাবে এ হামলা চালালো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুরো উপজেলা পরিষদ চত্বর সিসি ক্যামেরায় আওতায়। সেটাও পরীা করা হচ্ছে।’ এদিকে রংপুর র‌্যাব-১৩ প্রধান কমান্ডার রেজা আহাম্মেদ ফেরদৌস জানান, ‘আমরা ঘটনা জানার পরপরই পুরো এলাকা কর্ডন করেছি। আশেপাশের এলাকা থেকেও আমাদের একাধিক টিম যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেছে। আশা করি আমরা দায়ীদের ধরতে পারবো।’ রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার ওয়াদুদ ভুইয়া বলেন, ‘এটা একটা জঘন্য ঘটনা। এর সঙ্গে যারাই জড়িত থাক তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওয়াহিদা খানমকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’