প্রবাসে শিক্ষা: করোনার হানায় অনিশ্চয়তা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ চীনের ইউনান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আতিক রাফি। স্কলারশিপ নিয়ে গিয়েছিলেন চীনে। তার সময়টা কাটছিল স্বপ্ন পূরণের আশা নিয়ে । মাস ছয়েক না যেতেই সেই স্বপ্নে হানা দেয় করোনা। চলে আসতে বাধ্য হন দেশে। এখন অনলাইনে চলছে ক্লাস। কিন্তু ক্লাস অনলাইনে হলেও মনটা পড়ে আছে চীনে। রাফি বলেন, কপাল খারাপ হলে যা হয়। এমন সময় পড়তে গেলাম সবই বন্ধ হয়ে গেল।
অনলাইনে ক্লাস চলছে। এতে সেই অর্থে মজা মিলছে না। ৭০ শতাংশ স্কলারশিপ নিয়ে যাওয়ায় গুনতে হচ্ছে ৩০ শতাংশ টিউশন ফি। অসহায় লাগে নিজেকে। চীনে কিছু বন্ধু রয়ে গেছে, ওরাই ভালো করেছে। কেন যে আসলাম? তিনি জানান, এখন ক্যাম্পাসে যারা অবস্থান করছে তাদের ক্লাস হচ্ছে ভার্সিটিতে। বাকিদের অনলাইনে। ইংল্যান্ডের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের শিক্ষার্থী ফারজানা তিথি। আর এক বছর হলেই পাট চুকে যাবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের। করোনার প্রভাবে থমকে আছে তার শিক্ষা জীবন। কবে যেতে পারবেন তার নিশ্চয়তা নেই। অনলাইনে ক্লাস হলেও করছেন না তিনি। বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা আমার কাছে স্বপ্নের জীবন। আমি গবেষণার কাজ অসমাপ্ত রেখে এসেছি। আমি অনলাইনে কোর্স নিলে ভার্সিটি শেষ হয়ে যাবে আমি কাজটা শেষ করতে পারবো না। তিনি আরো বলেন, উভয় সংকটের মধ্যে দিন পার করছি। এমন চলতে থাকলে হয়তো রেজিস্ট্রেশন করে ফেলতে হবে। অসমাপ্তই রয়ে যাবে আমার কাজ।
আদিল রশিদ খান পড়েন জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব হ্যামবার্গে। বলেন, আমি ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ সেমিস্টার শেষ করে স্কলারশিপ পাই। প্রায় দুই বছর লেখাপড়া করার পর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়াটা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। দেশেও অনার্স শেষ করলাম না এখন জার্মানিতেও থমকে আছে। অনলাইনে ক্লাস চলছে। তবে, প্র্যাকটিক্যাল না হওয়া পর্যন্ত পাস করতে পারবো না। এভাবে চলতে থাকলে বিপদের মুখে পড়তে হবে। এসব শিক্ষার্থীরা করোনা মহামারির ফলে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পড়তে যাওয়া যেসব শিক্ষার্থী সেখানেই রয়ে গেছেন তারাও আছেন মহাবিপাকে। লাটভিয়ার রিগা টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন আলিফ হাসান। করোনার কারণে অনেকে দেশে ফিরলেও ফেরেননি তিনি। কাজ করতেন একটি রেস্তরাঁয়। সে কাজও বন্ধ। ডরমেটরিতে দিন গুনছেন কখন স্বাভাবিক হবে সবকিছু। অধিকাংশ সময় কাটে বদ্ধ ঘরে। ক্লাস চলছে অনলাইনে। বলেন, করোনার এই সময়টায় পরিবারের পাশে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু দেশেও থাকতে পারলাম না। আবার এখানে বাড়ি থেকে টাকা আনতে হচ্ছে। অনেক কষ্টে টাকা পাঠাচ্ছেন বাবা। খুব কষ্ট হয় এই টাকাটা নিতে। কিন্তু না নিয়েও যে উপায় নেই।
ভারতে সংক্রমণ বাড়ছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী নেই ক্যাম্পাসে। নীরবতা মাঝে মধ্যে ভাবিয়ে তোলে। হোস্টেলে অনেকে থাকলেও নিজেকে বড্ড একা লাগে। আছে নিরাপত্তাহীনতাও। এমনটাই বলেন, ভারতের ইউনিভার্সিটি অব মুম্বইয়ের শিক্ষার্থী আদ্রিতা দেবনাথ। তিনিও জানান, অনলাইনে ক্লাস চলছে তার। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার শিক্ষার্থী পড়তে যায় বিভিন্ন দেশে। সেখানে এ বছর করোনার কারণে চলতি সেমিস্টারে যেতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ জানায়, সামার সেমিস্টারে শিক্ষার্থী দেশের বাইরে গিয়েছেন মাত্র হাজার খানেক। আর নতুন শিক্ষার্থী আনুমানিক ২০ হাজার যাবার কথা ছিল। সেটা নেমে এসছে ৫শ’র নিচে। আর আগের সেমিস্টারে বাইরে শিক্ষার্থী যাবার সংখ্যা ছিল শূন্যের কোঠায়। এ ছাড়াও প্রতিবছর দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশে পড়তে আসেন ৩৫ দেশের প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়তে আসেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিলে। জানুয়ারিতে (স্প্রিং) ৫৫ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর এপ্রিলে (সামার) তা নেমে আসে ৩০ জনে। আর এবারের চলতি (ফল) সেমিস্টারে মাত্র একজন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন।
নেপাল থেকে রংপুর প্রাইম মেডিকেলে পড়তে এসেছেন নেহা তেয়াগী শর্মা। করোনার প্রভাবে বন্ধ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নেহা জানান, হোস্টেলে পুরোই সুনসান নীরবতা। বন্ধ শুরুর দিকে খাবারটাও ঠিকমতো পেতেন না। হোস্টেলে তারা কয়েকজন মাত্র বিদেশি শিক্ষার্থী। পরিবারের লোকজনের জন্য চিন্তা যেমন হচ্ছে ঠিক তেমনি চিন্তায় আছেন পরিবারের লোকজনও। বদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি। সোমালিয়া থেকে বাংলাদেশে পড়তে এসেছেন মোহাম্মদ আজিজ। রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী তিনি। বলেন, আমরা চাইলেও দেশে যেতে পারিনি। আর ধারণাও ছিল না করোনার এই প্রভাব এতো দীর্ঘ হবে। ক্লাস অনলাইনে হলেও মনে হচ্ছে কারাগারে আছি। শুরুর দিকে বাইরে যেতে ভয় করতো।