বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী নির্মাণ

0
ড. আবদুল লতিফ মাসুম
লরেন্স লিফসুজ তার বাংলাদেশ সম্পর্কিত গ্রন্থটির নাম দিয়েছেন ‘আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ বা অসমাপ্ত বিপ্লব। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামানও আমাদের অর্জনকে ‘অসমাপ্ত’ বলেছেন। বামতাত্ত্বিকরা বলেন, অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে ভিয়েতনামের মতো দীর্ঘায়িত যুদ্ধের মাধ্যমে দেশটি স্বাধীন হলে ‘জাতীয় মুক্তি’ অর্জিত হতো। ১৯৭১ সালে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতা দিয়েছে জাতি-পরিচয়। হয়তো বা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আরো ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন ছিল। বলা হয়, জাতীয়তাবাদ একটি বহতা নদীর মতো। অসংখ্য তীর ভেঙে, অনেক বাঁক পরিবর্তন করে তা পৌঁছে সাগর সঙ্গমে- মিলন মোহনায়। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের অনেক বাঁক পরিবর্তন অবশেষে আমরা পৌঁছেছি এই সময়ে। জাতিরাষ্ট্র বা নেশন স্টেট অর্জিত হলেই জাতীয়তাবাদের পূর্ণতা প্রাপ্তি না-ও ঘটতে পারে। তাই স্বাধীনতা অর্জিত হলে তা সংহত করার প্রশ্ন আসে। জাতিরাষ্ট্র গঠিত হলে তাকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে গড়ে তুলতে হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা হয়- প্রসেস অব নেশন বিল্ডিং বা জাতিরাষ্ট্র গঠনের কর্মসূচি। এ ধরনের আরো একটি টার্ম হলো- স্টেট বিল্ডিং বা রাষ্ট্র গঠনপ্রক্রিয়া। এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, জাতিরাষ্ট্র মন ও মানস গঠন করে। রাষ্ট্রের আদর্শ-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে। আর স্টেট বিল্ডিং রাষ্ট্রকাঠামোর দিকে নজর দেয়। প্রাতিষ্ঠানিকতা গুরুত্ব পায়। যেমন- বিদ্যালয় মানে বিদ্যা শিক্ষা-লেখাপড়া। আলয় মানে বিদ্যালয় গৃহ। বিদ্যা আছে গৃহ নেই তা যেমন অপূর্ণ, তেমনি চমৎকার নির্মাণ আছে কিন্তু বিদ্যা নেই- তা-ও অসমাপ্ত। দু’য়ের সমন্বয়ই জাতিরাষ্ট্রের পূর্ণতা। পাকিস্তানিরা দালান দিয়েছিল। বিদ্যা দেয়নি। তাই দালান কাজে আসেনি। ভারতীয়রা বিদ্যা দিচ্ছে দালান দেয়নি। তাই ঝড় ঝাপটায় বিধ্বস্ত কাঠামো।
কোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই একক উপাদানে পুষ্ট নয়। পাকিস্তান আন্দোলনে ইসলাম বা মুসলমানিত্ব প্রধান ছিল। তার মাঝে লুকায়িত ছিল বাংলা, বেলুচ, সিন্ধি ও সীমান্তের ভাষা, ভৌগোলিক, নৃগোষ্ঠীক জাতীয়তাবাদ। পাকিস্তানকে গ্রহণ করতে হয়েছে পূর্ববাংলায় এক বিরাটসংখ্যক সংখ্যালঘুকে। ভারত অখণ্ড জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছে। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের কথা বলেছে। প্রচ্ছন্ন থেকেছে রামরাজ্যের বাসনা। হিন্দু মহাসভা থেকে সাত দশক পরে হলেও ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর উত্তরণ ঘটেছে বর্তমান ভারতে। সুতরাং জাতীয়তাবাদ বস্তু নয়, আদর্শ। আদর্শের মৃত্যু নেই। সময়-অসময়ে আবর্তিত-বিবর্তিত হয় মাত্র।
বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের উন্মেষকালে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আন্দোলিত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। শিগগিরই অনুভূত হয়েছে ভৌগোলিক দূরত্ব। বৈষম্যের দলিল ক্ষুব্ধ করেছে মানুষকে- আঞ্চলিকতায়, দূরের বাস্তবতায়। স্বায়ত্ত শাসনের দাবি ছিল ভৌগোলিক। পাকিস্তানিরা বলত- ‘ইস্টার্ন উইং অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন উইং’-এ দু’পাখার মাঝের দূরত্ব হাজার মাইল। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- মাঝখানের দেহটি তার নয়, অন্যের। তাদের ভাষায় শত্রুর। পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কী করে তার নিজের ভাষায় এমন ‘মথ ইটেন’ পাকিস্তান গ্রহণ করেছিলেন তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক বিস্ময়। জন্ম থেকেই ধরবিহীন পাকিস্তান অভিহিত হয়েছে ‘ডবল কান্ট্রি’ বা ‘ইমপসিবল কান্ট্রি’ রূপে। সুতরাং তার যবনিকা ছিল নিয়তি। ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক এলিটরা জেদ না ধরলে উভয় ক্ষেত্রেই রক্তপাত এড়ানো যেত। হয়তো বা এই ছিল ভবিতব্য। অবশ্য সময়ের দাবি ঔচিত্যবোধে তাড়িত হয় না। প্রত্যুষে যে প্রদোষকাল থাকে মধ্যাহ্নে, অপরাহ্ণে অবশেষে সন্ধ্যায় তা পরিবর্তিত হয় অন্য রূপে।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ অর্জিত হওয়ার অব্যবহিত পরে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী বসন্ত চ্যাটার্জি তার ‘বাংলাদেশ ইনসাইড’ গ্রন্থে মুসলিম বাংলার আকাক্সক্ষা প্রত্যক্ষ করেন। দেয়ালে দেয়ালে মুসলিম বাংলার লিখন শোভা পায়। বাম নেতা সিরাজ শিকদারকে এ জন্য দায়ী করা হয়। সত্য এই যে, সাধারণ মানুষ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মাত্র। ভারতীয় সর্বোদয় নেতা আচার্য ত্রিপালনি নাকি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘শ্রিমতি গান্ধী কি বাপ এক পাকিস্তান বানায়ে থা, উচকা লাড়কি দু’পাকিস্তান বানায়ে থা’। শাসকদল জনগণের নাড়ির খবর না নিয়ে ইসলামী ঐতিহ্যকে নাকচ করার প্রবণতার প্রতিবাদে ওই প্রতিক্রিয়া ঘটে বলে বুদ্ধিজীবীদের মন্তব্যে জানা যায়। আগস্টের অনুঘটকরা ইসলামের কথা বলে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের কথিত ভারতপন্থী ক্যু-এর বিপরীতে কর্নেল তাহের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করেন। সৈনিকদের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও স্লোগান ঠিক করে দেয়া হয়। কিন্তু সাধারণ সৈনিকরা ‘নারায়ে তাকবির’ আর ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দেয়। কেউ তাদের এই স্লোগান শিখিয়ে দেয়নি। ওই স্লোগান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক। অল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে ওরা। বাম স্লোগান ছাপিয়ে তারা তাদের মৌল পরিচয়ে ফিরে যায়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সমর্থনে গোটা ঢাকার হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে আসে। আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। বিগত ৫০ বছরের ইতিহাসে মানুষকে এত খুশি হতে আর কখনো দেখিনি। দৈনিক ইত্তেফাকে এ দিনের সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল- ‘প্রাণ বন্যায় উচ্ছল নগরী’। দৈনিক বাংলা লিখেছিল ‘উল্লাসে উদ্বেল ঢাকা নগরী’। এই জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সমর্থনে ভারতীয় আগ্রাসনের ভীতি তাদের নির্দেশের সোপানকে অগ্রাহ্য করতে শেখায়।
যে জিয়াউর রহমানের কাঁধে বন্দুক রেখে কর্নেল তাহের বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন, সাধারণ সৈনিকরা তা ব্যর্থ করে দেয়। কোনো নেতা, দল বা গোষ্ঠী তাদের কোনোভাবে প্রভাবিত করেনি। স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের ইমেজ, মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং সতত জনপ্রিয়তার জন্য তা সম্ভব হয়। পরবর্তীকালে তিনি জনসাধারণের আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক সমর্থন লাভ করেন। ৭ নভেম্বরের চেতনাই ছিল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার ভিত্তিভূমি। পরবর্তীকালে এই স্বাতন্ত্র্যের চেতনাকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকতা দান করেন। তার শাসন প্রণালীর প্রতিটি ক্ষেত্রে তা অনুভূত হয়। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল ছিল জাতীয়তাবাদের সতত প্রবহমান চেতনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন। একটি মাইলফলক। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের জনগণের লালিত বিশ্বাস ও জীবনবোধের স্মারক। বাংলাদেশ মুক্ত হয় একটি বিশেষ বলয়ের অধীনতা থেকে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ঘটে জাতিসত্তার নতুন স্বীকৃতি। বহির্বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত এক স্বকীয়তা, সার্বভৌমত্ব। মুছে যায় প্রযত্নের পরিচিতি। আদর্শিক ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে বাঁক পরিবর্তনের নৈতিক ভিত্তি রচিত হলেই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংহত হয় না। প্রাথমিক আলোচনায় আমরা দেখেছি, এ জন্য চাই তাত্ত্বিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন। জিয়াউর রহমান ক্রমেই তার শাসনতান্ত্রিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেন। স্বাধীনতা-উত্তর জিয়াউর রহমানের এই প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান কথিত ‘জাতি গঠন’ এবং ‘রাষ্ট্র গঠন’ উভয়বিদ পর্যায়েই ব্যাখ্যা করা যায়। জাতি গঠন প্রক্রিয়াগুলো হচ্ছে- ক. স্বাধীনতার ঘোষণা; খ. বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ; গ. সাংবিধানিক পরিবর্তন; ঘ. বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন; ঙ. জাতীয় সংহতি নিশ্চিতকরণ ও চ. দেশপ্রেম। আর রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়াগুলোর অন্তুর্ভুক্ত ছিল- ক. বেসামরিকীকরণ; খ. জাতীয় নির্বাচন সম্পন্নকরণ; গ. ১৯ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন; ঘ. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি গঠন; ঙ. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন; চ. কর্মমুখী ও সৃজনশীল জাতি গঠনের লক্ষ্যে খাল কাটা কর্মসূচির মতো অনেক কর্মসূচি গ্রহণ; ছ. স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। দেশী-বিদেশী চক্রান্তে জিয়াউর রহমানের জীবনাবসান হলেও থেমে থাকেনি জাতীয়তাবাদী শক্তির বাংলাদেশ নির্মাণ।
সেনাছাউনি ও ক্ষমতা থেকে আবির্ভূত রাজনৈতিক দল বলে যারা উপহাস করছিলেন তারা দেখতে পান বিএনপি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিণত হয়েছে। দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্তব্য করেন, বেগম জিয়া সরকারি দলকে জনগণের দলে পরিণত করতে সক্ষম হন। (রওনক জাহান-২০১৫:৩১) এবার ক্ষমতাসীন দল হিসেবে নয়, ক্ষমতাচ্যুত দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতির রাষ্ট্র নির্মাণে বিএনপির ভূমিকা লক্ষ করা যায়। পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাবলি প্রমাণ করে, ‘এক জিয়া লোকান্তরে, লক্ষ জিয়া ঘরে ঘরে’। প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠে বিএনপি। অবশেষে হাল ধরেন জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া। তার নেতৃত্বে দলটি ঘুরে দাঁড়ায়। জাতি গঠন এবং রাষ্ট্র গঠন পর্যায়ে আমরা জিয়াউর রহমান আমলের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেখেছি। এ পর্যায়ে একইভাবে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির কার্যক্রম তথা সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ান দেখতে চাইব। বেগম জিয়া জাতি গঠনের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বাইরে ও ভেতর থেকে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেন তা হচ্ছে- ক. জাতীয় ঐক্যের পুনর্গঠন; খ. সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন; গ. তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গ্রহণ। আর রাষ্ট্র গঠনের পর্যায়ে তার কার্যাবলি এরকম- ক. অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বারোপ; খ. শিক্ষাক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়ন ও ব্যাপক সংস্কার সাধন; গ. ডাল-ভাত কর্মসূচি গ্রহণ; ঘ. দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প বাস্তবায়ন; ঙ. বেসরকারিকরণ; চ. আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে ‘র‌্যাব’-এর মতো প্রতিষ্ঠান গঠন; ছ. পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারসাম্য সাধন, লুক ইস্ট পলিসি অনুসরণ ও সার্ককে পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস।
এ ধরনের বহুমুখী কার্য সম্পাদনের পর যথারীতি বিএনপির মেয়াদ ফুরিয়ে আসে। সংবিধান মোতাবেক ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জটিলতা নিরসনে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ব্যর্থ হন। অবশেষে সেনাবাহিনী সমর্থিত কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ওয়ান-ইলেভেনের নাটকীয় ইতিহাসের পর ‘ইকোনমিস্ট’ কথিত ‘প্যাকেজ ডিল’-এর নির্বাচনে বস্তা বস্তা টাকার বিনিময়ে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা লাভ করে। নির্বাচনের পর ক্ষমতাচ্যুত বিএনপি সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করে। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ইস্যু- তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতির ব্যাপকতা, বন্দুকযুদ্ধের নামে অবৈধ হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরের নির্মমতা ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে বিএনপি রাজপথে সরব থাকে। ক্ষমতা থেকে যেমন ক্ষমতার বাইরে থেকেও জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের যথার্থ নির্মাণের স্বপ্ন দেখে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা হিসেবে ঘোষিত হয় ‘ভিশন-২০৩০’। গণতন্ত্র, সুশাসন, পরিষেবা, সামাজিক নিরাপত্তা অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষ থেকে সম্ভাব্য পরিকল্পনা ঘোষিত হয়। এ পরিকল্পনায় জাতি গঠন শিরোনামে- ক. রাজনৈতিক-সামাজিক বিভাজন অবসানের প্রতিশ্রুতি দেয়া; খ. একটি সুসংহত জাতি গঠনের প্রত্যয় ঘোষণা করা, গ. বৈষম্য ও ভেদবুদ্ধির বেড়াজাল অতিক্রমের সিদ্ধান্ত দেয়া; ঘ. সব মতাদর্শের ঐকতান রচনার স্বপ্ন দেখা এবং ঙ. প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়তে চায় বিএনপি। এ জন্য এক নতুন সামাজিক চুক্তি বা সোস্যাল কন্ট্রাক্টে পৌঁছতে চায় বিএনপি। জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের নির্মাণের সফলতা নির্ভর করে উত্তর প্রজন্মের রাজনীতির ওপর। বিএনপি এ ক্ষেত্রে ভাগ্যবান যে, তাদের কাক্সিক্ষত ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। রক্তের উত্তরাধিকার ও আদর্শের উত্তরাধিকার যেথা এক দেহে হলো লীন- সেই তারেক রহমান দুঃসময়ের কাণ্ডারি হিসেবে বলিষ্ঠভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পিতার সাহসী প্রজ্ঞা এবং মায়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ধারণ করার উদাহরণ আর কোথাও নেই। ‘কাজেই বাংলাদেশ আজকের প্রজন্মের অন্য যেকোনো রাজনীতিবিদের চেয়ে তার অভিজ্ঞতা-অভিজ্ঞান ভিন্নতর এবং অবশ্যই তাৎপর্যমণ্ডিত’।
ওয়ান-ইলেভেনের ষড়যন্ত্রমূলক সময়কাল থেকে বিগত ১৩ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার ভেতর ও বাইরে দুটোকেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় বিএনপিকে যে সীমাহীন নির্যাতন, নিপীড়ন, গুম, খুন ও মামলা-হামলার সম্মুখীন হতে হয়েছে তা অস্বাভাবিক। সে নির্যাতনের ইতিহাস রচনায় মহাকাব্য রচনা করা যায়। শুধু তাই নয়, বিএনপির রাজনৈতিক অধিকার অস্বীকার করা হয়। একে নিশ্চিহ্ন ও নির্মূল করার কোনো পদক্ষেপই বাদ দেয়া হয়নি। বিএনপি নির্বাচনী জালিয়াতির ফাঁদে প্রতারিত হয়েছে বারবার। অথচ যেকোনো নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিএনপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের সম্ভাবনা সবসময়ই ছিল এবং এখনো আছে। প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী বর্তমান সময়ের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ওপর থেকে দেখতে খুবই শান্ত কিন্তু নিচে অদৃশ্যমানভাবে ঘূর্ণিস্রোত বইছে। তাতে যেকোনো সময়ে যেকোনো অঘটন ঘটতে পারে।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ আগস্ট ২০২০) অঘটন কাঙ্ক্ষিত নয়। বিএনপি নেতৃত্বের মতো দেশের সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে, বিএনপি যেকোনো ভবিষ্যৎ নির্বাচনে বা গণ-অভ্যুত্থানে ফিনিক্স পাখির মতোই জেগে উঠবে। জাতীয়তাবাদী নির্মাণে অতীতের মতো সমুজ্জ্বল হবে বাংলাদেশ। জাতি ও রাষ্ট্র গঠন-প্রক্রিয়া অবশেষে অসমাপ্ত বাংলাদেশের সমাপ্তি ঘটবে- গণতন্ত্রের লক্ষ্যে সমৃদ্ধির সোপানে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]