প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ প্রাগৈতিহাসিক ধারণা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ এই মুহূর্তে দেশে প্রতি চারজনে একজন যুবক বেকার এবং প্রতি তিনজনে একজন শিক্ষিত যুবক বেকার। অর্থাৎ যে যতো শিক্ষিত সে ততো বেকার থাকছে। এই সময়ে দেশের যুবসমাজ একটা অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে পড়েছে। কারণ আগেই তাদের কর্মসংস্থানের বাজার অনেক দুর্বল ছিল এখন করোনা মহামারির পরে কী হবে আমরা জানি না। আমি খুবই জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করছি বারবার যে, এই যুবসমাজের জন্য একটি অবশ্যই বেকার ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি এদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা না করি তাহলে বাংলাদেশে গত ১০ বছরে সরকারের যে বড় অর্জন সেটি দুর্বল হয়ে যাবে। এজন্য কর্মসংস্থান একটি বড় বিষয়। এদিকে মনোযোগ দেয়া খুবই জরুরি। রোববার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন।
আলতাফ হোসাইনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানটি মানবজমিন-এর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সরাসরি প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, শুধুমাত্র প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা এটা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হলেই যে সবার উপকার হয় তা নয়। অর্থনীতিবিদরা প্রবৃদ্ধি নির্ভর অর্থনীতি বহু আগে ফেলে দিয়েছে। এখানে আবার মৌলিক চাহিদার কথা এসেছে। এরপর আমরা সাম্প্রতিককালে মানব উন্নয়ন সূচকের ভেতর গেছি, সেখানে শুধুমাত্র আয় নয়, সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় এসেছে। এরপর এখনতো আমরা বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে গেছি যেটাকে আমরা এসডিজি বলি। সেখানে শুধু শিক্ষা, কর্মসংস্থান নয়, সেখানে নাগরিক অধিকার, কথা বলার অধিকার, সমাবেশের অধিকার, আইনের শাসনসহ ইত্যাদি বিষয় এখন চলে এসেছে। সেখানে প্রবৃদ্ধি দিয়ে উন্নয়নকে বোঝানো এটা একমাত্র প্রাগৈতিহাসিক অর্ধশিক্ষিত এবং সংকীর্ণ চিন্তার ফলাফল। আসলে আপনার চিন্তা করতে হবে সাধারণ মানুষের তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণ তারা দিতে পারছে কি-না, একটা গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে পারছে কি-না, স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছে কি-না, নিরাপত্তা দিতে পারছে কি-না, কথা বলার অধিকার দিতে পারছে কি-না। এই প্রবৃদ্ধির যে পরিমিতি এতে যে গরমিল আছে এটা আমরা পরিষ্কার করেছি। এটার সঙ্গে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের কোন মিল নাই, ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবাহের মিল নাই, এটার সঙ্গে পুঁজিপতির আমদানির মিল নাই, কর্মসংস্থানের মিল নাই, শিল্প উৎপাদনের মিল নাই এগুলো আমরা পরিষ্কারভাবে দেখেছি এর বৈপরীত্য। প্রবৃদ্ধি নিয়ে এতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা ঠিক নয় এখানে টেকসই উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
দেশে টাকা পাচারের বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকে জিজ্ঞেস করেন যে, আইনের বরখেলাপ আছে নাকি প্রাতিষ্ঠানিক অসুবিধা। এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকার নতুন আইন করছে এবং সাম্প্রতিককালে বাজেটে একদিকে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দিয়েছে অন্যদিকে আবার জরিমানার পরিমাণও বাড়িয়ে দিয়েছে। কী রকম বৈপরীত্য দেখেন- এক হাতে বলছে চুরি করো আরেক হাতে বলছে চুরির টাকা আমরা নিয়ে নেবো। বিদেশে টাকা পাচারকারীদের নাম বিদেশি পত্রিকাসহ বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেলো কিন্তু সরকারতো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ সরকারের নেই। আমার কথা হলো এটা এক সময় অর্থনীতির বিষয় ছিল, এরপর এটি রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয় হয়েছে, এখন এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়। এখন রাজনৈতিকভাবে যদি এর ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে এর কিছু হবে না। যেমনটি ক্যাসিনো-কাণ্ডে হয়েছে। এটা নির্ভর করে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। সেটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, করোনা আমাদের উলঙ্গভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমরা গত এক দশক ধরে যা বলে আসছি তা সঠিক ছিল। আমরা বলেছি, আমরা একটি মধ্য আয়ের দেশে আমরা যাচ্ছি, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হচ্ছি। আর মাত্র আমার দেশজ আয়ের এক শতাংশ ব্যয় করা হবে স্বাস্থ্য খাতের জন্য, এটা কোনো ভদ্র সমাজে হয়? আর আমরা এক শতাংশ দেবো তার ২০-২৫ শতাংশ ব্যবহার করতে পারবো না- এটা হতে পারে না। আর যেটা ব্যবহার করবো সেটার ১০ টাকার জিনিস হাজার টাকা দিয়ে কিনে এনে বলবো আমি হাজার টাকার কাজ করেছি। আসলে ১০ টাকার কাজ করেছি- কোনো সভ্য সমাজে দুর্নীতির এই মাত্রা হতে পারে না। তিনি বলেন, তিনটি জিনিস আমরা বলেছি, আপনি টাকা কম দিচ্ছেন, দ্বিতীয়ত বাস্তবায়ন করতে পারছেন না এবং তৃতীয়ত যা করছেন তার ভেতরে দুর্নীতি অনেক আছে। এই বিষয়গুলো আপনি করোনা পরিস্থিতিতে উৎকটভাবে দেখছেন। কী দেখলেন? আপনি জাল সার্টিফিকেট দেন, পরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা নেই, যার ফলে পুরো বিদেশে আমাদের বদনাম হয়ে গেছে।
অর্থনীতির বৈষম্য নিয়ে খ্যাতিমান এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সারা পৃথিবীতেই এই বৈষম্য দেখা যায় তবে আমাদের দেশে এটি বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে কৃতিত্ব অর্জন করেছে দ্রুততম ধনী হওয়া দেশ হলো বাংলাদেশ। আর অন্যান্য দেশে যদি পরিশ্রম করে হয় অন্যদিকে আমার দেশে পুরোটাই হলো সংযোগ, সম্পর্ক এবং দুর্নীতির মাধ্যমে হচ্ছে। একদিকে আমরা গরিব কমিয়েছি অন্যদিকে তারচেয়ে ঠিক ততোগুণ বেশি ধনীদের হাতে সাম্প্রতিককালে অর্থনীতি যতোটুকু উন্নয়ন হয়েছে তা পুঞ্জিভূত হয়েছে। এই যে কিছু লোক ধনী হয়ে গেল বেশি। আর আমার দেশে সবচেয়ে পরিশ্রমি মানুষগুলো- কৃষক, শ্রমিক এবং প্রবাসে যারা কষ্ট করে যে বাংলাদেশ বানাচ্ছে আর ওইসব উচ্চবিত্তের যে বাংলাদেশ এটা দুই বাংলাদেশ। আর ওইসব উচ্চবিত্ত যারা মালয়েশিয়ায়, সিঙ্গাপুর, আমেরিকায় বাড়ি বানায়, তারা বেগম পল্লী বানায় কানাডাতে, কিন্তু আমার মধ্যবিত্ত যারা আছে তারা আমার দেশে বিনিয়োগ করে।
দেশে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, আমার দেশের নাগরিকদের কি অসহায় অবস্থা দেখেন। দেখেন যদি ধরেই নেই যে, সে কোনো অন্যায় কাজের সঙ্গে যুক্ত তবুওতো বিনা বিচারে হত্যা, এটাতো কোনো আইনানুগ কাজ হতে পারে না। আপনি কোনো অবস্থাতেই মানুষের মৌলিক বিচারের অধিকারকে নিয়ে নিতে পারেন না। এটাকে অনেকে সমর্থন করে, খুশি হয়। কারণ, যেহেতু একটা অকার্যকর বিচার ব্যবস্থা আছে, যেখানে একটা লোককে সঠিকভাবে শাস্তি দিতে পারি না। অনেক পদ্ধতিতে সে জামিন নিয়ে নেয় বের হয়ে যায়। বের হয়ে আবার ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। তখন অনেকে মনে করে মেরে ফেলাই বোধহয় ভালো। দেখেন কী একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমার সাধারণ কথা হলো বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা উচিত নয়।